মন্দা কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আবাসন খাত। তবে এখনো ফ্ল্যাটের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, জমির দামের কারণে ফ্ল্যাটের দাম বেশি। সরকার আবাসন ব্যবসায়ীদের কম দামে জমি দিলে ফ্ল্যাটের দাম মধ্যবিত্তের নাগালে নামিয়ে আনা সম্ভব। রাজধানীতে চলছে আবাসন মেলা। আবাসন খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আবাসন প্রতিষ্ঠান কনকর্ড রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহরিয়ার কামাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব।
প্রথম আলো: দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে কনকর্ড। অনেকেই ব্যবসা করছে, কিন্তু ব্র্যান্ড হতে পেরেছে আপনাদের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। কনকর্ডের এই সাফল্যের মূলমন্ত্র কী?
শাহরিয়ার কামাল: আবাসন ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুনাম ও ব্র্যান্ড। আজকের অবস্থানে আসতে আমরা শুরু থেকে দুটি দর্শন নিয়ে কাজ করেছি। চাকরিতে যোগদানের সময় কনকর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয় আমাকে বলেছিলেন, মানুষকে ঠকিয়ে তুমি সাময়িকভাবে লাভবান হতে পারবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা করতে পারবে না। আমরা সব সময় তা অনুসরণ করছি। আমরা গ্রাহকদের সঙ্গে যে অঙ্গীকার করি, তা শতভাগ পালন করার চেষ্টা করে থাকি। ব্যবসায় উত্থান-পতন থাকবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে গ্রাহকদের সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সব সময় মানসম্মত কাজ করার চেষ্টা করছি, কাজের মানে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু যুক্ত করার চেষ্টা করেছি। আজকের এই অবস্থানে আসতে এসব বিষয়ই আমাদের সহায়তা করেছে।
প্রথম আলো: এ খাতে আপনাদের মতো আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে যেমন ব্যবসা করছে, তেমনি প্রতারণাও করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। এটা কেন?
শাহরিয়ার কামাল: যেকোনো ব্যবসায় খারাপ অবস্থা আসতে পারে। একটির কারণে সবারই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। আমাদের মতো যারা আবাসন ব্যবসায়ী বা রিহ্যাবের সদস্য, তারা সবাই চেষ্টা করছে মানসম্পন্ন কাজ করার। মাঝেমধ্যে অনেকে আগ্রাসীভাবে ব্যবসায় আসে, এমনভাবে প্রকল্প নেয় যেখান থেকে মুনাফা করতে পারে না। তাই সময়মতো গ্রাহককে ফ্ল্যাটও বুঝিয়ে দিতে পারেন না। আবার রাজউকের শর্তও ভাঙছে। কয়েকজনের কারণে সবার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। তাই রিহ্যাবও কিছু নীতিমালা করে দিয়েছে। প্রতারণার দায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে। এখন প্রতারণার ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে।
প্রথম আলো: রিহ্যাবের সদস্যপদ বাতিল করলেই তো গ্রাহকের দাবি পূরণ হয় না। গ্রাহক তো টাকা ফেরত পায় না?
শাহরিয়ার কামাল: ঠিক বলেছেন, এ ধরনের শাস্তিতে গ্রাহকের কোনো উপকার হয় না। এ জন্য গ্রাহককে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বছরে ৮-১০ হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তর হচ্ছে। এর বাইরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বাজারে আছে। সরকার একটা নীতিমালা করে দিয়েছে, আবাসন প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হলে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যাবে। রিহ্যাব চেষ্টা করে অনেক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। রিহ্যাবকে অনুরোধ করব আরবিট্রেশন সেলকে আরও শক্তিশালী করতে। যাতে গ্রাহকদের অভিযোগগুলো দ্রুত সুরাহা করা যায়।
প্রথম আলো: ফ্ল্যাটের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে কী উদ্যোগ প্রয়োজন?
শাহরিয়ার কামাল: আমাদের রাজধানী বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতি এলাকার মধ্যে একটি। এখানে মানুষপ্রতি জমির পরিমাণ খুব কম। ফলে এ শহরে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়, তার একটা বড় খরচ চলে যায় জমিতে। এটা চেষ্টা করলেও কমানো যাবে না। এর বাইরে নির্মাণ খরচ, রড স্টিলের দাম আছে। রেজিস্ট্রেশন খরচ আছে, যেটা আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি। সরকার যদি রেজিস্ট্রেশন খরচ কমিয়ে আনে, তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের খরচ কমে আসবে। এ ছাড়া সুদের হারও অনেক বেশি। একসময় বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আবাসনে কম সুদে ঋণ চালু হয়েছিল। সরকার নতুন করে এমন উদ্যোগ নিতে পারে। কারণ, আবাসনের বিনিয়োগ সবচেয়ে নিরাপদ। এতে খেলাপি হলেও ফ্ল্যাট থেকে যায়। সাধারণ মানুষের নাগালে ফ্ল্যাটের দাম আনতে হলে ঢাকা শহরের পরিকল্পিত সম্প্রসারণ দরকার। এ ছাড়া সরকার যদি বেসরকারি খাতের সঙ্গে মিলে আবাসন প্রকল্প হাতে নেয়, তাহলে দাম কমে আসবে। ইংল্যান্ডে আমি দেখেছি, কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন আবাসন গড়লে নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য একটা কোটা ছিল। বাংলাদেশে এমন সম্ভাবনা আছে কি না জানি না। তবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কিছু প্রকল্প হলে তাতে সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট কোটা থাকতে পারে।
প্রথম আলো: আবাসন ব্যবসা কেমন যাচ্ছে? রিহ্যাবের এক হাজার সদস্যের অধিকাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসা করছে। এতে করে কি অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে?
শাহরিয়ার কামাল: রিহ্যাবের সদস্যের চেয়ে তিন গুণ প্রতিষ্ঠান ঢাকাতেই প্রতিযোগিতা করছে। এর ফলে অবশ্যই একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। ২০১১-১২ সালে যে দাম পড়ে গেল, এর প্রধান কারণ ছিল অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই অনেকে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে আঁচ করতে পেরে আমরা ব্যবসা কমিয়ে এনেছিলাম। মন্দার কারণে অনেকে এ ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ে। আমরা আশা করি, মানুষ এটা মনে রাখবে। আবাসন ব্যবসা কারা করতে পারবে, তার জন্য একটা নীতিমালা থাকা উচিত। যেখানে এ ব্যবসা করতে মূলধন কত লাগবে, কতজন প্রকৌশলী ও স্থাপত্যবিদ থাকতে হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা থাকবে। এসব করলে আমরা সংকট থেকে বের হতে পারব। এখন অনেকে চাইলেই আবাসন ব্যবসা শুরু করছে।
প্রথম আলো: ঢাকায় যত্রতত্র আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। এতে করে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। পরিবেশবান্ধব আবাসন প্রকল্প করতে কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন?
শাহরিয়ার কামাল: পরিবেশবান্ধব আবাসন বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের এখানে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। লোকজন ঢাকায় আসছে, বিভিন্ন এলাকার চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। আবাসিক এলাকায় আগে ২ থেকে ৪ তলার অনুমোদন ছিল। এখন তা ৩০ তলা পর্যন্ত হচ্ছে। শিল্প এলাকাকে বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত করেছি। বাংলাদেশে যথাযথ নগরায়ণ নীতিমালা না থাকায় এমনটা হচ্ছে। আমাদের এখানে নিচু জমি, জলাধার হারিয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছে, সবুজ প্রকৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এখন সবার আগে প্রয়োজন নগরায়ণের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা। যাতে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি চিন্তা করে আবাসন গড়ে তোলা হয়। রাজধানীতে যেসব বস্তি আছে, সেগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। একমাত্র যথাযথ নগরায়ণ নীতিমালাই পারে আবাসন খাতকে নতুন করে সাজাতে।