আন্দোলন: মালিক-শ্রমিক পক্ষের মত

তৈরি পোশাকশিল্পের নতুন মজুরিকাঠামো নিয়ে শ্রম–অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। গত রোববার থেকে আন্দোলন করছেন পোশাকশ্রমিকেরা। কেন এমন হলো সে বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

শ্রমিকদের আন্দোলন যৌক্তিক নয়

মো. সিদ্দিকুর রহমান
মো. সিদ্দিকুর রহমান

প্রথম আলো: নতুন মজুরিকাঠামো নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন কি যৌক্তিক, নাকি অযৌক্তিক। আপনারা মালিকপক্ষ কী মনে করছেন?
সিদ্দিকুর রহমান: কোনোভাবেই শ্রমিকদের আন্দোলন যৌক্তিক নয়। কারণ ৫ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৭ হাজার টাকার বেশি নিম্নতম মজুরি দেওয়ার সক্ষমতা পোশাকশিল্পের নেই। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে আমরা ৮ হাজার টাকা মেনে নিয়েছি। তা ছাড়া শ্রমিকেরা সব সময়ই একটা যুক্তি দেখান, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িভাড়া বেড়ে যায়। আমরা সে জন্য এবার বাড়িভাড়াকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। মূল মজুরির ৪০ শতাংশের জায়গায় বাড়িভাড়া ৫০ শতাংশ করে দিয়েছি। সেটি শ্রমিকদের পছন্দ হয়নি। পছন্দ না-ও হতে পারে। সে জন্য আমরা আগেই বলেছি, মজুরিকাঠামোর কোনো জায়গায় কোনো ব্যত্যয় হলে সেটি আমরা পুনর্বিবেচনা করব। বাড়িভাড়া ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিলাম, এখন সেটি কমিয়ে দিলেই মূল মজুরি বেড়ে যাবে। সে জন্য রাস্তায় নেমে নামতে হবে, আন্দোলন করতে হবে, ভাঙচুর করতে হবে, এটি তো কোনোভাবে বরদাশত করা যায় না।
প্রথম আলো: নিম্নতম মজুরি বোর্ড সাত থেকে আট মাস কাজ করার পর নতুন মজুরিকাঠামো চূড়ান্ত করেছে। তারপরও সেই কাঠামোতে দু-তিনটি ত্রুটি বের হলো। তাহলে মজুরি বোর্ডের কার্যক্রমে কি কোনো ধরনের দুর্বলতা ছিল?
সিদ্দিকুর রহমান: ত্রুটিবিচ্যুতির কিছু হয়নি। কাঠামোতে ৩ নম্বর গ্রেডে ৪০ টাকা মূল মজুরি কমে গেছে। কিন্তু বাস্তবে তা কমবে না। এই গ্রেডের একজন শ্রমিক মোট মজুরি পাবেন ১৩-১৪ হাজার টাকা। তা ছাড়া মজুরি বোর্ডের পরিষ্কার নির্দেশনা দেওয়া আছে, কারও মজুরি কিংবা সুবিধাদি কমবে না। তাই নতুন কাঠামোতে ভুলত্রুটির কিছু নেই, পুরোটাই বোঝার ভুল।
প্রথম আলো: শ্রমিকনেতাদের অভিযোগ, ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বেড়েছে। সেটি মজুরি বোর্ড হিসাব না করার কারণেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আপনি তো বোর্ডে ছিলেন। প্রকৃত ঘটনা কী?
সিদ্দিকুর রহমান: আমার কি কারখানা নেই? আমি কি ব্যবসা করি না? প্রতিবছর আমরা শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি করেছি। এটি সবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও জানি। সেটি হিসাবে না নিলে হিসাব মিলবে কীভাবে?
প্রথম আলো: তাহলে একটি গ্রেডে যে মূল মজুরি কমে যাচ্ছে, সেটি কি আপনাদের নজরে আগে আসেনি?
সিদ্দিকুর রহমান: অবশ্যই নজরে আসছে। ৪০ টাকাকে আমরা বড় করে দেখিনি। কারণ যে শ্রমিকের পকেটে ১৩-১৪ হাজার টাকা যাচ্ছে, তাঁর কাছে ৪০ টাকা কোনো টাকাই না। কাঠামোতে কমলেও বাস্তবে কারখানাগুলো যখন মজুরি দেবে, তখন সেটি কমানোর কোনো সুযোগ নেই।
প্রথম আলো: নতুন মজুরিকাঠামো নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা এখন কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে যাচ্ছেন?
সিদ্দিকুর রহমান: সমস্যা সমাধানে সরকার গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটির বৈঠকে গত বৃহস্পতিবার আমি শ্রমসচিবকে বলেছি, যেভাবে সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সমাধান চাই। বৈঠকে শ্রমিকনেতারা বাড়িভাড়া বাড়লেও মূল মজুরি কমে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাই মোট মজুরি ঠিক রেখে মূল মজুরি ঠিকঠাক করে দেওয়া হবে। আগামী রোববার পরের বৈঠকেই আমরা একটা সমাধানে পৌঁছে যাব।
প্রথম আলো: প্রতিবারই মজুরি বৃদ্ধির সময় এলেই পোশাকশিল্পে শ্রম অসন্তোষ দেখা দেয়। আপনারা কি ভেবে দেখেছেন, কেন এমনটা হয়?
সিদ্দিকুর রহমান: শ্রম অসন্তোষ যেন না হয়, সে জন্য আমরাই প্রথম মজুরি বোর্ড গঠনের জন্য সরকারকে সুপারিশ করি। তারপর মজুরি বোর্ড হয়। নতুন কাঠামো ঘোষণার আগেই যদি গন্ডগোল হতো, তাহলে আমরা মেনে নিতাম। আসলে মজুরি নিয়ে কোনো সমস্যাই নেই। নতুন মজুরিকাঠামোতে অধিকাংশ শ্রমিকই খুশি। আমরা যতই চেষ্টা করছি, পোশাক খাত একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে আইনকানুনের মধ্য দিয়ে চলুক, ততই একটি গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা করে।

মালিকদের ইচ্ছামতোই সব হয়েছে

আমিরুল হক
প্রথম আলো: শ্রমিক, মালিক ও নিরপেক্ষ সদস্যের সমন্বয়ে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়েছিল। তাঁরা সবাই মিলেই নতুন কাঠামো করেছেন। তারপরও সেই নতুন মজুরিকাঠামো নিয়ে শ্রমিকেরা অসন্তুষ্ট। কেন এমনটা হলো?
আমিরুল হক: মজুরি বোর্ড যেটি গঠন করা হয়েছিল, আমার দৃষ্টিতে সেই প্রক্রিয়াটিই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। যখন কোনো নির্দিষ্ট খাতের জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়, তখন সেখানে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের একজন করে প্রতিনিধি থাকেন। শ্রমিকদের প্রতিনিধি সংশ্লিষ্ট খাতের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্য থেকে হয়ে থাকেন। কিন্তু এবার কোনোটাই করা হয়নি। যাঁকে শ্রমিক প্রতিনিধি করা হলো, তিনি পোশাকশিল্পের কোনো শ্রমিক সংগঠনের নেতা বা সদস্য নন। এমনকি তিনি পোশাক কারখানায় কখনো শ্রমিক বা কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন, তা–ও না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, মজুরি বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধি নির্বাচন করাটাই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আগের মজুরি বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধি খাতের অন্য শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করেছেন। এবারের কমিটির শ্রমিক প্রতিনিধি সেটি করেননি। আরও কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল। খসড়া মজুরি হওয়ার পর একটি নিয়ম আছে, ১৫ দিনের মধ্যে শ্রমিক সংগঠন বা সংশ্লিষ্ট যে কেউ আপত্তি, পরামর্শ ও মতামত দিতে পারবে। আমাদের অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনের জোট খসড়া মজুরি নিয়ে আপত্তি লিখিত আকারে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেসব নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা তো দূরে থাক, কিছুই আমলে নেয়নি বোর্ড। প্রয়োজনও বোধ করেনি।
প্রথম আলো: আপনি বললেন, নিম্নতম মজুরি বোর্ড শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়োগ ত্রুটিপূর্ণ ছিল। খসড়া মজুরি নেয় আপনাদের আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি। তাহলে কি মজুরি বোর্ডে মালিকেরা যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই সব হয়েছে? আমিরুল হক: আমার কাছে মনে হয়, মজুরি নিয়ে মালিকপক্ষ যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই সবকিছু হয়েছে। তবে নিম্নতম গ্রেডের মজুরি নির্ধারণের বিষয়ে আগের দুবার প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঠিক করে দিয়েছেন। সে জন্য মালিকপক্ষ ভেবেছিল, প্রধানমন্ত্রী এবারও নিম্নতম গ্রেডের মজুরি বিষয়ে মতামত দেবেন। শেষ পর্যন্ত সেটি প্রধানমন্ত্রী করেও দিয়েছেন। তবে নিম্নতম গ্রেড ছাড়াও অন্যান্য গ্রেডের মজুরি নিয়ে আলোচনা দরকার ছিল। সেটিও মালিকপক্ষ করেনি।
প্রথম আলো: শ্রমিকেরা কেন এতটা বিক্ষুব্ধ হলেন। দিনের পর দিন আন্দোলন করছেন। মূল সমস্যা কোথায়?
আমিরুল হক: আমার দৃষ্টিতে সামগ্রিক মজুরিকাঠামোতে দুটি বড় সমস্যা আছে। তার একটি হচ্ছে, নতুন কাঠামোতে বাড়িভাড়াসহ প্রান্তিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গতবারের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেগুলো বৃদ্ধি করতে গিয়ে মূল মজুরি আসলে কমে গেছে। মূল মজুরি আগে একসময় মোট মজুরির ৬০ থেকে ৬৬ শতাংশ ছিল। ২০১৩ সালে সেটি ৫৬ শতাংশ করা হয়। আর এবারের কাঠামোতে মূল মজুরি আরও কমে ৫১ শতাংশে নেমে গেছে। এই মূল মজুরি কম হওয়ায় শ্রমিকেরা ওভারটাইমের অর্থ, ঈদের বোনাস ও অবসরকালীন ভাতা কম পাবেন। চাকরিচ্যুত হলে ক্ষতিপূরণও কম পাবেন। এই সবকিছুই মূল মজুরি ধরে হিসাব করা হয়। এসব অসংগতি শ্রমিক সংগঠনের পাশাপাশি সাধারণ শ্রমিকেরাও বুঝতে পেরেছেন। সে জন্যই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নিম্নতম মজুরি ৮ হাজার টাকা নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু পোশাকশিল্পের মূল শক্তি হচ্ছে দক্ষ অপারেটর। যাঁরা কিনা ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডে কাজ করেন। এই তিন গ্রেডেই মজুরি বৃদ্ধির হারটি কম হয়েছে।
প্রথম আলো: নতুন মজুরিকাঠামোর এ সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়? আমিরুল হক: সমস্যা সমাধানে সরকার ত্রিপক্ষীয় কমিটি করেছে। গত বৃহস্পতিবার একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে আমরা বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা মূল মজুরি বৃদ্ধি করার কথা বলেছি। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরের ইনক্রিমেন্ট হিসাব করে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডের মজুরি পুনর্বিবেচনা করে আরেকটু বৃদ্ধি করে দেওয়া।

 

আরও পড়ুন...