মানবসম্পদ

অসমতায় শিক্ষা লাভেও বৈষম্য

  • এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধনী দেশ বা ধনী পরিবারের শিশুরা আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষায় ভালো করে থাকে।

  • সারা বিশ্বের ১৬০ কোটি শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না।

  • লকডাউনের কারণে শিক্ষা লাভে বৈষম্য হচ্ছে।

সারা বিশ্বের ১৬০ কোটি শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না।

ধনী দেশের শিশুরা উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের তুলনায় ভালো শিক্ষা পায়। আর ভালো শিক্ষা যারা পায়, ভবিষ্যতে কর্মী হিসেবেও তারা বেশি উৎপাদনশীল হয়। ফলাফল হচ্ছে—ধনী দেশের এই ভালো শিক্ষা পাওয়া ছাত্রদের কল্যাণে ধনী দেশগুলো আরও ধনী হচ্ছে। পরিবার বা দেশের আয় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শুধু আয়ের ওপরই ব্যাপারটা নির্ভর করে না, ভালো শিক্ষা পাওয়ার বেলায় অসমতার মাত্রা বড় ভূমিকা পালন করে।

তবে টাকা দিয়ে ঠিক কী উপায়ে শিক্ষা কেনা যায়, তার পরিষ্কার রূপরেখা পাওয়া না গেলেও এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধনী দেশ বা ধনী পরিবারের শিশুরা আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষায় ভালো করে থাকে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক দেব প্যাটেল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের জাস্টিন সানদেফুর পরিচালিত আ রোসেটা স্টোন ফর হিউম্যান ক্যাপিটাল শীর্ষক সমীক্ষায় এই ফল পাওয়া গেছে। এখানে দুটি প্রসঙ্গ চলে আসে—ধনী দেশের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে কি এরা ভালো করছে, নাকি পরিবারের ধন-সম্পদের কল্যাণে তারা ভালো শিক্ষা পাচ্ছে?

জটিল এক পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁরা এই মূল্যায়ন করেছেন। ৮০টি দেশের ভিন্ন পরীক্ষা পদ্ধতিকে আন্তর্জাতিক পরীক্ষার মানদণ্ডে বিচার করে দেখেছেন দুই গবেষক। তাতে অবশ্য আয়ের সঙ্গে ভালো শিক্ষার সোজাসাপ্টা সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ পরিবারের আয় বেশি হলেই যে এই ছাত্ররা ভালো ফল করেছে তা নয়, এর সঙ্গে অন্য কিছুরও যোগ আছে।

দেখা গেছে,

  • ১. ধনী ও উন্নয়নশীল দেশের সম–আয়ের পরিবারের শিশুরা একই নম্বর পায়নি—ধনী দেশের শিশুরা উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশি নম্বর পেয়েছে;

  • ২. যেসব দেশে অসমতা বেশি, সেই সব দেশে পরিবারের বার্ষিক আয় বেশি হওয়ার সঙ্গে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার সম্পর্ক আছে;

  • ৩. সব শ্রেণি–পেশার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় ভালো পড়াশোনা করে। তবে যেসব দেশে অসমতা বেশি, সেখানেই কেবল মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় গণিতে বেশি নম্বর পায়;

  • ৪. যেখানে অসমতা বেশি, সেখানে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পার্থক্যও বেশি।

মাথাপিছু জিডিপির ব্যবধান বেশি হলে একটি দেশের শিশুদের শিক্ষাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অসমতা দেখা যায়—এমনকি একই শ্রেণি–পেশার পরিবারের মধ্যেও ব্যবধান থেকে যায়। যেসব দেশে অসমতা কম, সেখানে এই ব্যবধান কম।

নরডিক দেশগুলোতে অসমতার মাত্রা কম। তাঁরা দেখেছেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে এই আন্তসম্পর্কের মান খুবই কম—যথাক্রমে শূন্য দশমিক ০১৭ ও মাইনাস শূন্য দশমিক ০০১৭। বিপরীতে লাতিন আমেরিকার উচ্চ বৈষম্যপূর্ণ দেশ কলম্বিয়া, ব্রাজিল ও গুয়াতেমালার ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৪১, শূন্য দশমিক ৩৯ ও শূন্য দশমিক ৩৪।

ধনী দেশে যেসব পরিবারের বার্ষিক আয় ৫ হাজার ডলার, সেই পরিবারের সন্তানেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড সায়েন্স স্টাডিতে (টিআইএমএসএস) ১ হাজার নম্বরের মধ্যে ৫০০ নম্বর পেয়েছে। আর জাপানি মানদণ্ডে পরিচালিত একই পরীক্ষায় ১ হাজার নম্বরের মধ্যে তারা পেয়েছে ৫৬০। অন্যদিকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ কোস্টারিকার মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলার হলেও সেখানকার শিশুরা একই মানের পরীক্ষায় পেয়েছে মাত্র ৪৬০।

গণিতের ক্ষেত্রে গবেষকদ্বয় পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের আন্তসম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। নরডিক দেশগুলোতে অসমতার মাত্রা কম। তাঁরা দেখেছেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে এই আন্তসম্পর্কের মান খুবই কম—যথাক্রমে শূন্য দশমিক ০১৭ ও মাইনাস শূন্য দশমিক ০০১৭। বিপরীতে লাতিন আমেরিকার উচ্চ বৈষম্যপূর্ণ দেশ কলম্বিয়া, ব্রাজিল ও গুয়াতেমালার ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৪১, শূন্য দশমিক ৩৯ ও শূন্য দশমিক ৩৪।

ছেলে-মেয়ে বৈষম্য

সব শ্রেণির মেয়েদের বেলায় দেখা যায়, পড়ার ক্ষেত্রে তারা ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে আছে। তবে গণিতের ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা বেশি নম্বর পায় বলে দেখা যায়। আর পরিবারের বার্ষিক আয় তিন হাজার ডলার হলে গড়পড়তা ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি নম্বর পায়। তবে সমাজে নারীর অবস্থানের ওপরও মেয়েদের শিক্ষাপ্রাপ্তি অনেকটা নির্ভর করে। যে দেশে মেয়েদের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হওয়ার হার আরেক দেশের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ বেশি, সেই দেশের মেয়েরা গণিতে অন্তত ২ দশমিক ৫ কম নম্বর পায়।

লকডাউনে বৈষম্য বাড়ছে

মহামারির শুরু থেকে সারা বিশ্বের ১৬০ কোটি শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। এতে অনেক বড় ক্ষতির মুখে পড়বে তারা। অন্যদিকে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে ধনী পরিবারের শিশুদের সঙ্গে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ব্যবধান আরও বাড়ছে। শহরের সচ্ছল পরিবারের শিশুরা যেখানে অনলাইনে ক্লাস করছে, সেখানে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিশুরা টানা প্রায় ১০ মাস ধরে শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের এসব দরিদ্র পরিবারে ডিজিটাল যন্ত্র নেই, নেই ইন্টারনেট সংযোগ।

পাশাপাশি লকডাউনের কারণে নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিবারের শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে তাদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এটি। উন্নত দেশগুলোর সরকার বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে এই প্রভাব হ্রাসের চেষ্টা করছে, কিন্ত উন্নয়নশীল দেশে সেই পরিসর অত্যন্ত সীমিত।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, অসম দেশে পরিবারের আয় বাড়লে শিশুরা বেশি নম্বর পায়। যেসব দেশে সম্পদ কেন্দ্রীভূত, সেখানে অভিজাতেরা সন্তানদের বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াতে চান। কিন্তু যেখানে বৈষম্য কম, সেখানে একই সরকারি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সন্তানেরা পড়াশোনা করে। উন্নয়নশীল দেশে সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। তাই সেখানে এই চিত্র দেখা যায় না। তাই দেখা যাচ্ছে, দেশে সমতা থাকলে শিক্ষার মানেও সমতা থাকে।