অর্থ ও নীতিকে একসঙ্গে মেলানো খুব সহজ নয়। একটি পাওয়া গেল তো অন্যটায় ঘাটতি। অর্থ আছে তো নীতি নেই। কিংবা নীতি ঠিকঠাক, কিন্তু অর্থের সংকট। তবে একই সঙ্গে দুটোরই সংকট অনেক দিন দেখা যায়নি। বিদায়ী ২০১৯ সালে সংকট ছিল অর্থ ও নীতি—দুটোরই।
২০১৯ সালে আয় কমে গেছে দেশের। সরকারের আয়ের মূল উৎস দুটি। অভ্যন্তরীণ আয়ের মূল উৎস রাজস্ব আয় এবং বৈদেশিক উৎসে রপ্তানি। দুটোতেই বড় ঘাটতি। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় কমেনি, বরং খরচ বাড়ছে। আয়-ব্যয়ের মধ্যে বড় অসংগতির প্রভাব এরই মধ্যে অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়েছে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সারা অর্থবছরের ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল, সাড়ে পাঁচ মাসেই তা পূরণ করে ফেলেছে।
অর্থনীতির মৌলিক নীতি ভেঙে ফেলা দেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু বিদায়ী বছরে এই প্রবণতা দেখা গেছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। একদিকে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে এক অঙ্কের সুদহার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ায় মোটেই তা কার্যকর হয়নি। আবার ভ্যাট আইন নতুন হলেও শেষ সময়ে এসে সিদ্ধান্ত বদলে আগের আইনের অনেক কিছু রেখে দেওয়া হয়েছে। বিনিময় হারকে কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে কেবল প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনা দেওয়ায় রপ্তানি খাতের সংকটের সুরাহা হয়নি। আর নগদ আদায় না বাড়িয়ে কেবল সংজ্ঞা বদল করে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা চলেছে। তারপরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
বিশ্বজুড়ে এবং যুগ যুগ ধরে অর্থনীতিবিদেরা বলে আসছেন যে অর্থনীতির সমস্যা অর্থনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। রাজনৈতিক ভাবনায় অন্য কিছু করতে গেলেই সংকট বরং বাড়ে। ব্যাংক খাত এর বড় উদাহরণ। সুদহার হবে ৯ শতাংশ—এই সিদ্ধান্তের পর ব্যাংক খাতে এর নামই হয়ে গেছে ‘হুকুমের সুদ’। বছরজুড়েই এ রকম বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেই বছরজুড়ে সমালোচনা হয়েছে।
সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন চাপের মধ্যে। অথচ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে বাংলাদেশকে বহু বছর ধরেই সংকটে থাকতে হয়নি। ২০১৯ সালে সেই সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক খাতে রয়েছে অব্যবস্থা ও সুশাসনের অভাব। এরই প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ভালো ছিল শুরুটা
অথচ বছরের শুরুটা কিন্তু ভালো ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসীন। একই সঙ্গে নতুন অর্থমন্ত্রী। তবে প্রথম ছয় মাস ছিল আগের
অর্থবছরের (২০১৮-১৯) ধারাবাহিকতা। শেষ পর্যন্ত অর্থবছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। যদিও পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে সমালোচনা ছিল বিভিন্ন মহলের। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯০৯ ডলার। এ সময়ে মূল্যস্ফীতিও ছিল নিয়ন্ত্রণে। এমনকি বছরের শুরুর শেয়ারবাজার দেখেও বোঝা যায়নি পরে তা তলানিতে নেমে যাবে।
>বছরের শুরুটা ভালো হলেও শেষটা ভালো যাচ্ছে না। নানা সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি এখন চাপের মুখে।
দুই বছর আগে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আইন বাস্তবায়ন করার সময় ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আগেই ঘোষণা ছিল, ২০১৯–এর জুলাই থেকে নতুন আইন কার্যকর হবে। আর এই নতুন আইন রাজস্ব আয় বাড়াবে বলেও বড় আশাবাদ ছিল। তবে ব্যাংক খাত নিয়ে ভালো কোনো আশাবাদ বছরের কখনোই ছিল না।
সংকট যেখানে বেশি
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস (জুলাই-নভেম্বর) সময়ে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। রপ্তানি আয় যদি শেষ পর্যন্ত এই ধারায় থাকে, তাহলে ১০ বছর পর এবারই প্রথম রপ্তানি আয় হবে ঋণাত্মক। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ধাক্কা খেলেও বাংলাদেশ এর আগে কখনো রপ্তানি আয়ে এ রকম ধাক্কা খায়নি।
আবার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আয়ে ঘাটতি দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু ২০১৯ সাল অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস ছিল আগের অর্থবছরের অংশ। এ সময়ে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ছিল ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতির এই হিসাব বাজেট সংশোধনের পরই। মূল বাজেটের হিসাবে ঘাটতি ৭২ হাজার কোটি টাকা। এত বড় ঘাটতি দেশের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি।
রাজস্ব ঘাটতির এই প্রবণতা পরের চার মাসেও দেখা গেছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে আয়ে ঘাটতি ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ, অথচ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আয় বাড়াতে না পারলে অর্থনীতির সংকট আরও বাড়বে।
সংকট আমদানিতেও। আমদানির সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে গত অক্টোবর পর্যন্ত। এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ হারে আমদানি কমেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, এই চার মাসে শিল্প স্থাপনের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। একই সময়ে ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির হারও কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ যে আসছে না, এটা তারই লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন নিজেও মনে করেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব ভালো নয়, বেশির ভাগ সূচক চাপের মধ্যে। এর মধ্যে কয়েকটি সূচকের পতন অর্থনীতির জন্য বেশি খারাপ। যেমন রপ্তানি আয়। কেননা, এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি সরাসরি জড়িত। মীর নাসির বলেন, বাংলাদেশের টাকা এখনো অনেকটাই অতিমূল্যায়িত। অথচ প্রতিযোগী সব দেশ রপ্তানিতে টিকে থাকতে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে পর্যায়ক্রমে টাকার অবমূল্যায়ন এবং রপ্তানিকারকদের সঠিক সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারই বড় গ্রহীতা
রাজস্ব আয় কম হওয়ায় খরচ মেটাতে সরকার এখন অনেকটাই ব্যাংকনির্ভর। ব্যয় মেটাতে প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংক থেকে সরকারকে এখন টাকা ধার করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ধার করার লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। আর ৬ মাস না যেতেই সরকার নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
সরকার এভাবে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করলে ব্যাংক খাতে চাপ আরও বাড়বে। আবার এতে ঋণে বেসরকারি খাতের অংশ কমে যাবে। যেমন এরই মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ৯ বছরে সর্বনিম্ন। অথচ চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ধরা আছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করা হয় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।
সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ
প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি এখন ২২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এটি একটি নতুন রেকর্ড এবং এখন পর্যন্ত সরকারের অন্যতম স্বস্তির জায়গা। এই আয় দেশের ভেতরে চাহিদা বাড়াবে বলেই সরকারের প্রত্যাশা, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হবে।
বিশ্ব অর্থনীতিও চাপের মধ্যে আছে। চীন ও ভারতের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল বেশি পাচ্ছে ভিয়েতনাম। এখন পর্যন্ত তাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হবে নতুন বছরের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আবার বছরের বেশির ভাগ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও শেষ দিকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। আরও বাড়তে না দেওয়াটাও হবে সরকারের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ।
তবে সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটির নাম হচ্ছে রাজস্ব। এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে না পারলে অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হবে। যদি রপ্তানি বৃদ্ধি পায়, বেসরকারি বিনিয়োগ গতিশীল হয়, কেবল তবেই রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হবে। আর এ জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় কমাতে হবে। বছরের শেষ মুহূর্তে এসে সরকার সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হবে বলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। তা হবে আগামী এপ্রিল থেকে। বিশ্বমন্দার আশঙ্কায় সারা বিশ্বই এখন নিম্ন সুদহারের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নেই। তবে হুকুমের এই সুদহার কার্যকর করাই হবে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আউশ, বোরো, আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে—এটি বিদায়ী বছরের ভালো খবর। তবে বিদায়ী বছরে সামষ্টিক অর্থনীতির পুরোনো সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। যেমন ব্যাংক খাত। আবার রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবং সরকারি ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে—এই দুটি নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে বছরের শুরুতে নতুন অর্থমন্ত্রী অনেক আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়তে দেবেন না। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বছর ধরে ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে, যার উল্টো ফল দিয়েছে। বাজার পরিস্থিতি উপেক্ষা করে হুকুম দিয়ে সুদের হার ৯ শতাংশ করা হলো। সবকিছু হুকুম দিয়ে হয় না। অতীতেও হয়নি। আমরা অতীত থেকে শিখছি না। ঋণখেলাপিদের শাস্তি দিতে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই।’
সবশেষে জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতিতে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সব সমস্যায় ‘আগুন’ জ্বলছে না। ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে আগুন জ্বলছে। এটির সমাধানে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।