সংসদ সদস্য পদ হারানো লক্ষ্মীপুর-২ আসনের মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের কাছে আয় ও সম্পদের যে তথ্য দিয়েছিলেন, সেখানে বিপুলসংখ্যক আয়ের কোনো দৃশ্যমান উৎস দেখাননি। কিন্তু সাংসদ থাকা অবস্থায় মানব পাচার, ভিসা জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েত থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল দেশটির পুলিশ। এরপর কুয়েতের অপরাধ তদন্ত সংস্থা মানব পাচার এবং প্রায় ৫৩ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) পাচারের দায়ে মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। এরপর তাঁকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন কুয়েতের ফৌজদারি আদালত।
২০১৮ সালে টাকার জোরে মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম কেবল সাংসদই হননি, তাঁর স্ত্রীকেও সংরক্ষিত আসনের সদস্য বানিয়েছেন। এ জন্য বিপুল অর্থ লেনদেনের তথ্য সে সময়েই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। এই অর্থ লেনদেনের সঙ্গে কারা কারা জড়িত ছিলেন, সেই তথ্যও সবার জানা। কিন্তু একের পর এক তথ্য প্রকাশিত হলেও সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এ কারণেই হয়তো তাঁর অর্থ পাচারের তথ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও জানতে পারেননি। কুয়েত সরকারের কাছে ধরা না পড়লে আজ অর্থমন্ত্রীর পাশে বসেই তিনি সম্পূরক বাজেটের আলোচনা শুনতেন। এমনকি হয়তো টাকা পাচারের বিরুদ্ধে বক্তব্যও দিতেন।
এই তো গত ২৯ মে অনুসন্ধানী সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরান স্ত্রীর নামে এক সাংসদের কানাডায় বাড়ি কেনার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, কানাডার টরন্টো থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে স্কারবোরো শহরে হেয়ারউড সড়কের ৭৩ নম্বর বাড়িটির মালিক বাংলাদেশি নাগরিক শামীমা সুলতানা ওরফে জান্নাতী। তাঁর নিজস্ব আয়ের কোনো উৎস নেই। বাংলাদেশি পাসপোর্ট অনুযায়ী ‘গৃহবধূ’ শামীমা সুলতানা নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুলের স্ত্রী। ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনা হয়, আর সব মিলিয়ে বাড়িটি কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা। এই টাকা বাংলাদেশ থেকেই গেছে।
আজ জাতীয় সংসদে টাকা পাচার নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল, আর অর্থমন্ত্রী জবাবে অর্থ পাচারকারীর তথ্য চাচ্ছিলেন, তখন নাটোরের ওই সাংসদ অধিবেশনকক্ষে ছিলেন কি না, এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে টাকা কীভাবে পাচার করা হয়, অর্থমন্ত্রী চাইলে এখনো তাঁর কাছে প্রশ্ন করতে পারেন। বলে রাখা ভালো, আজ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে এঁরা এঁরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন।’
বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের কথা বেশি আলোচনার আর দরকার নেই। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলের পরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এখন তিনি কানাডায় বহাল তবিয়তে আছেন। তাঁর লোকজন কিন্তু এখন দেশে দাপটের সঙ্গেই আছেন, তিনি নিজেও সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়িয়েছেন। অর্থমন্ত্রী যদি চান, অন্তত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের কাছ থেকেও অনেক তথ্য জানতে পারবেন।
অর্থমন্ত্রীকে আরেকটি সহজ উৎসের কথা বলা যায়। যেমন তাঁরই সহকর্মী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। গত নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। আর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া ২৮টি ঘটনার মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করেছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল, রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ী আছেন।’ সুতরাং অর্থমন্ত্রী অন্তত ২৮ জন পাচারকারীর নাম তো চাইলেই জানতে পারবেন।
প্রসঙ্গক্রমে আরও জানিয়ে রাখি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরেই হাইকোর্ট বিষয়টি নজরে এনে তথ্য চাইলে দুদক আদালতকে তথ্য দেয় গত ১৭ ডিসেম্বর। এ সময় অর্থ পাচারের অপরাধে ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত দুদক কতগুলো মামলা করেছে, কতগুলো অভিযোগ তদন্ত করেছে, কত টাকা বিদেশ থেকে ফেরত এনেছে, প্রতিবেদনে সেসব তুলে ধরেছিলেন দুদকের আইনজীবী। এ সময় বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এগুলো তো আগে করছেন। পুরাতন কাহিনি বলে তো লাভ নাই। ২২ (নভেম্বর) তারিখের পর কী করেছেন?’
২২ নভেম্বরের পরে যে কী হয়েছে, তা আসলে কেউই জানি না। জানলে কি আর অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে অর্থ পাচারকারীর নাম জানতে চাইতেন?
বরং একটি সন্দেহের কথা বলি। আসলেই কি টাকা পাচারকারীর নাম আমরা জানতে চাই? নাম জানার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কি কখনো কোনো সরকার নিয়েছে? পাচার করা অর্থ ফেরত আনার প্রসঙ্গ এলেই তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের নাম বলা যায়। এরপরে কি আর কোনো উদাহরণ আছে? জাতীয় সংসদেই ২০১৪ সালের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তাঁর সরকার আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবে এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কথাও বলেছিলেন। গত সাত বছরে কি এর কোনো অগ্রগতি আছে? টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কী করছে, অর্থমন্ত্রী কি কখনো জানতে চেয়েছেন? এ নিয়ে তাদের সঙ্গে একটি বৈঠকও কি হয়েছে?
একটা প্রস্তাব দিতে পারি। প্রকল্পের নামে অহেতুক বিদেশ সফর নিয়ে আজকাল অনেক সমালোচনা হচ্ছে। টাকা পাচারকারীর তথ্য জানতে বিদেশ সফরের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? একটা দল যেতে পারে কানাডায়, সেখানকার বেগম পাড়ায় কিন্তু তাঁরা অবশ্যই যাবেন। সেখানে কার কার নামে বাড়ি কেনা আছে, সেই তথ্য সহজলভ্য, আনুষ্ঠানিকভাবেই পাওয়া যায়। আরেকটি দল যেতে পারে থাইল্যান্ডে। সেখানে দেশের একটি বড় শিল্প গ্রুপের বিশাল সাম্রাজ্য আছে। একটি দল যোতে পারে সিঙ্গাপুরে, সেখানে এক বড় ব্যবসায়ী একাধিক পাঁচ তারকা হোটেল কিনে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। এভাবে মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনও সফর করা যেতে পারে। এই সফরকারীরা যদি সত্যিকার অর্থেই সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে কাজটি করেন, তাহলে অন্তত এই বিদেশ সফরে জনগণ আপত্তি করবেন না। আর অর্থমন্ত্রীও টাকা পাচারকারীদের নাম জানতে পারবেন।
না হয় নাম জানতে পারলেন, কিন্তু নাম নিয়ে তারপর কী করবেন অর্থমন্ত্রী?