এক দশক ধরেই বাংলাদেশ গড়ে ৬ শতাংশের বেশি মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধিকে আরেকটু বাড়িয়ে ৭ শতাংশে নিয়ে যেতে পারছে না।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বেসরকারি বিনিয়োগের ফাঁদ থেকে বের হতে পারলেই কেবল বাংলাদেশ ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। আর এ জন্য প্রয়োজন সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশ। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল বলেই মনে করছে সংস্থাটি। তবে অনিশ্চয়তাও আছে।
গতকাল মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের কার্যালয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা যখন ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে এই সংশয়ের কথা বলছিলেন, তার খানিকটা দূরেই তখন সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অনুমোদন নিয়ে বৈঠক হচ্ছিল। আর সেই পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন। এই লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী বলে বৈঠকেই অর্থমন্ত্রী সমালোচনা করেছেন।
বেসরকারি খাত কেন বিনিয়োগ করছে না—সেই প্রশ্ন উঠল বিশ্বব্যাংকের সংবাদ সম্মেলনটিতে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বললেন একটি সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশের অভাবের কথা। তিনি বলেন, দেশে সামগ্রিকভাবে একটি সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশে ঘাটতি আছে। একজন বিনিয়োগকারী যদি দেশের মধ্যে বা বিদেশে পণ্য বিক্রি করা নিয়ে স্বস্তিতে না থাকেন, তা হলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেবেন না। তিনি বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা একটি বড় বিষয়। এর সঙ্গে আরও আছে পরিবহন ও বন্দরের মতো অবকাঠামো-সুবিধা পাওয়া। এর পাশাপাশি সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কথা বলছে। এটাও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশে জমি পাওয়া একটি বড় সমস্যা।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর গতকাল হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের অর্জন ও ঝুঁকিগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। সংস্থাটির পূর্বাভাস হচ্ছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সংস্থাটি মনে করছে, প্রাক্কলন করা এই প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হবে ভোগ ও রপ্তানি। পাশাপাশি সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সরকার যে বেতনকাঠামোর অনুমোদন দিয়েছে, তা প্রবৃদ্ধি গণনায় দশমিক ৯ শতাংশ বিন্দু যুক্ত হবে।
প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দিয়ে ড. জাহিদ হোসেন অবশ্য বলেছেন, সংখ্যা নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। কারণ, এতে কেবল তাপই ছড়ায়, আলো দেয় না। বিশ্বব্যাংক এ সময় জানায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস হচ্ছে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, আর আইএমএফ বলছে সাড়ে ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক আরও মনে করে, চলতি অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য, তাও আওতার মধ্যেই থাকবে। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর ব্যাপারে সাবধানী এবং আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল।
প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর সঙ্গে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্পর্ক বিষয়ে কিছু উপাত্তও প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন, ২০১০-১৫ সময়ে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ, আর একই সময়ে মোট বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২৮ শতাংশ। একই সময়ে চীনের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বিনিয়োগের হার ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ভারতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, বিনিয়োগ ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে শ্রীলঙ্কা। দেশটি ২৮ দশমিক ১ শতাংশ বিনিয়োগ করেও জিডিপি বাড়িয়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে। কারণ, দেশটি তাদের উপকরণগুলো উৎপাদন বাড়াতে বেশি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছে।
বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন জাহিদ হোসেন। তাঁর ভাষায়, বিশ্ব অর্থনীতি এখন পৌষ মাসের সকালের মতো অবস্থায়। তখন কুয়াশা থাকে, সামনের কিছু তেমন দেখা যায় না। এর একটি প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে থাকবে। বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ ঝুঁকিও আছে। যেমন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরবরাহব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমেছে। তবে আমদানি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে। এ ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের প্রশ্নটি চলে আসে। কেননা, পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৩০ শতাংশ। অথচ এর সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগের চিত্রটি মিলছে না। পুঁজি যন্ত্রপাতির শুল্কহার সর্বনিম্ন। এর ফলে এসব যন্ত্রপাতি আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার সহজ। সুতরাং বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।