দেশে আগামী ১৩ অক্টোবর রোববার থেকে ২২ দিন মা ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। সে জন্য জেলে ও বাণিজ্যিক জাহাজগুলো শেষ মুহূর্তে সাধ্যমতো ইলিশ ধরায় ব্যস্ত। তবে এবার মাছ তেমন ধরা পড়েনি বলে তারা জানায়। এমনটা আগের কয়েক বছরেও শোনা গেছে। যদিও সরকারি নথি ভিন্ন কথা বলছে।
সরকারি হিসাবে দেশে কয়েক বছর ধরে ইলিশের আহরণ বেড়েছে, কিন্তু দাম কমেনি; বরং তা বেড়েই চলেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে শুধু গত এক বছরে ইলিশের দাম ৩৩ শতাংশের মতো বেড়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের বাজারে আকার ভেদে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৬৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। জেলে ও ব্যবসায়ীরা জানান, দাম বেশ বেড়েছে।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাধারণত সরবরাহ বাড়লে দাম কমে; কিন্তু ইলিশের ক্ষেত্রে এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত ১৮ বছরে ইলিশের জোগান বা সরবরাহ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। সেই তুলনায় দাম না কমে বরং বেড়েছে।
ইলিশ আহরণ ও বিপণনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কাগজে-কলমে ইলিশের আহরণ বেশি দেখানো হলেও বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। বাস্তবে ইলিশ মিলছে কম। এর ওপর সীমান্তবর্তী এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হাতে জব্দ হওয়ার ঘটনায় ইলিশ পাচারের অভিযোগ জোরালো হচ্ছে।
ক্রেতাদের প্রশ্ন—প্রতিবছর ইলিশ আহরণ বাড়লেও দামে কোনো প্রভাব নেই? নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো মাঝেমধ্যে তদারকি অভিযান চালালেও তাতে কখনোই দাম কমে না।
১৩ অক্টোবর ইলিশের প্রজনন মৌসুম শুরু হবে। সে জন্য মা ইলিশ রক্ষায় শুরু হবে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এ সময় সাগর-নদীতে সব ধরনের মাছ শিকার বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে এবার ইলিশের মৌসুম শেষ হবে। কারণ, এরপর জাটকা ধরায় নভেম্বর থেকে আট মাসের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে।
‘কাগজে-কলমে’ আহরণ বাড়ে
দেশে অভ্যন্তরীণ জলাশয় তথা নদী ও সমুদ্র থেকে ইলিশ আহরণ করা হয়। বলা হয়, যে বছর নদীতে আহরণ কমে, সে বছর সমুদ্রে আহরণ বাড়ে। আবার সমুদ্রে আহরণ কমার বছরে নদীতে ধরা বাড়ে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাত বছর ধরে ইলিশের আহরণ বেড়েছে। এ ছাড়া ১৮ বছরে ইলিশের আহরণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। যেমন ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছিল পৌনে তিন লাখ টন বা সাড়ে ২৭ কোটি কেজি, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৭১ হাজার টন বা প্রায় ৫৭ কোটি কেজি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তথ্য এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে চলতি অর্থবছরেও ইলিশের আহরণ বেড়েছে বলে মনে করা হয়।
সরকারি হিসাবে ইলিশের আহরণ বাড়লেও জেলেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের দাবি, বিগত পাঁচ বছরে ইলিশের আহরণ কমেছে। বিশেষ করে ছোট নৌকা বা ট্রলারে মাছ আহরণ কমেছে। বাণিজ্যিক জাহাজগুলোও বলছে একই কথা। জেলেরা বলছেন, বছরে কয়েক দফা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। গত কয়েক বছরে ইলিশ ধরা পড়ছে কম। বাণিজ্যিক আহরণও তেমন হয়নি সাগর উত্তাল থাকায়।
সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। অবশ্য মাছ ধরার সমুদ্রগ্রামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর হিসাব হয় চট্টগ্রামের নামে। এর বাইরে ভোলা, খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।
সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের পরিচালক মো. আবদুস ছাত্তার বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন ও সাগরে জেলি ফিশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ইলিশসহ অন্যান্য মাছ আহরণে প্রভাব পড়ছে। তবে ইলিশের আহরণ ভালোই আছে। গত বছরের তুলনায় এবার আহরণ সামান্য কমেছে। বাণিজ্যিক জাহাজের সার্বিক খরচ বেড়েছে, তাই দামে প্রভাব পড়তে পারে।
দফায় দফায় দাম বেড়েছে
বাংলাদেশের রপ্তানির নীতিতে ইলিশ রপ্তানি শর্তসাপেক্ষ। সরকার অনুমোদন দিলেই কেবল রপ্তানি করা যায়। যদিও ইলিশের দাম বাড়ার জন্য অনেকেই রপ্তানির কথাই বলেন। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে মোট আহরিত ইলিশের মাত্র শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ রপ্তানি হয়। অর্থাৎ ৯৯ দশমিক ৭১ শতাংশ ইলিশ দেশেই থাকে, তাহলে ভরা মৌসুমেও দাম না কমার কারণ কী—ক্রেতাদের এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
সরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে, এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে ইলিশের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জোগান কম হওয়ায় এবং আহরণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ইলিশের দাম বাড়তি।
মহাজন বা দাদনদাতাদের কাছ থেকে দাদন তথা চড়া সুদে টাকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যান জেলেরা। বিক্রির সময় এই দাদনদাতাদের কমিশন দিতে হয়। এর বাইরে নিলামে ইলিশ কেনার পর ব্যাপারীরা নিজেরাই দাম বাড়িয়ে দেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ইলিশের দাম কেজিতে প্রায় ৪০০ টাকা বেড়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রতি কেজি ইলিশের গড় দাম ছিল ৭০৫ টাকা ৫০ পয়সা, সেখানে ২০২৩ সালে তা বেড়ে ১ হাজার ৯৫ টাকা ৯০ পয়সা হয়েছে। অর্থাৎ সাত বছরে দাম ৫৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। চলতি ২০২৪ সালে দাম আরও বেড়ে ১ হাজার ১৬৮ টাকা ৫৬ পয়সায় উঠেছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানির খবরের পর দেশের কিছু জায়গায় ইলিশ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। কিছু বাজারে ইচ্ছা করেই দাম বাড়ানো হয়েছে। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ঢাকা, চাঁদপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযোগ পেলে চট্টগ্রামেও অভিযান হবে।