চীনে যত দিন ধরে এটা প্রচলিত যে ধনী হওয়া গৌরবের বিষয়, প্রায় তত দিন ধরে এটাও প্রচলিত যে দেশের বাইরে যাওয়াটাও গৌরবের। চীনের সচ্ছল ও ধনী মানুষের অন্য দেশে যাওয়ার প্রবণতা থেকেই বিনিয়োগ–অভিবাসন ব্যবসার সূত্রপাত। ইনভেস্টমেন্ট মাইগ্রেশন কাউন্সিলের তথ্যানুসারে, বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশ দ্রুততার সঙ্গে বসবাসের (গোল্ডেন ভিসা) ও এমনকি নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে। অর্থাৎ অন্য দেশের নাগরিকেরা বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করলে তাঁদের এই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, যেসব দেশ বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাস বা এমনকি নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কর্মসূচি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু চীনের নাগরিকদের পক্ষে এই পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব পাওয়া কঠিন। ২০২২ সাল পর্যন্ত এ জন্য তাঁদের অন্তত ১৫ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ছাড়া ভানুয়াতু ও নেভিসের মতো ছোট দেশের জন্য এই বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দেওয়া বিদেশি মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় উৎস।
বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি চীনের নাগরিকদের মধ্যেই। কিন্তু তারাই একমাত্র নয়, আরও অনেক দেশের মানুষ এখন বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষ দেশত্যাগ করতে চায়। এই দেশত্যাগের নানা কারণ আছে—কেউ নিপীড়ন এড়াতে দেশত্যাগ করতে চান, কেউ আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার এড়াতে দেশত্যাগ করতে চান। কেউ আবার নিছক সন্তানদের ভালো শিক্ষা দিতে বা ভালো পরিবেশ ও আবহাওয়ায় কাজ করতে দেশত্যাগ করেন। বিনিময়ে তাঁরা দেশে যে অর্থ পাঠান, তা সেই ব্যক্তি ও দেশ উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন তথ্যে দেখা গেছে, বিষয়টি বিতর্কিত।
প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, সেই দেশে কাদের বসবাসের অধিকার আছে। অর্থাৎ কারা সেখানে থাকতে পারেন আর কারা নন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে গোল্ডেন ভিসা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেনজেন ভিসার কল্যাণে সহজেই ইউনিয়নভুক্ত বেশির ভাগ দেশে ভিসা ছাড়া চলাচল করা সম্ভব। কিন্তু ইউনিয়নভুক্ত যেসব দেশ বিনিয়োগের বিনিময়ে ভিসা ও পাসপোর্ট দেয়, তাদের সঙ্গে এ নিয়ে ইউনিয়নের দীর্ঘমেয়াদি লড়াই চলছে।
ইউরোপীয় কমিশন এবং ওইসিডি বা ধনী দেশগুলোর জোটের দীর্ঘদিনের শঙ্কা, এই গোল্ডেন ভিসা আদতে অর্থ পাচারের হাতিয়ার। এই ভীতি ভিত্তিহীন নয়। ২০১৮ সালে চীনের বিনিয়োগকারীরা গ্রিসে এক জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেটা হলো, গ্রিসের ডেভেলপাররা বাজারমূল্যে সম্পদ কিনে চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছিলেন। এরপর ডেভেলপাররা সেই অর্থের কিছুটা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিয়েছিলেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২২ সালে গোল্ডেন পাসপোর্টে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও গোল্ডেন ভিসায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ইউনিয়নের জয় হয়েছে। কিন্তু ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মাল্টা এখনো বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দিয়ে যাচ্ছে। ভিসার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ কঠোর হচ্ছে।
২০২৩ সালে গ্রিস বিনিয়োগের সীমা দ্বিগুণ করেছে। দেশটির বেশ কিছু লোকপ্রিয় স্থানে বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিনিয়োগ সীমা ৫ লাখ ইউরোতে উন্নীত করেছে তারা। তারপরও গ্রিসের বিরোধী দলগুলো মনে করে, এই স্কিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কিমগুলোর অন্যতম। তারা এ সুযোগ একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে।
৮ এপ্রিল এই কর্মসূচি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্পেন। সে দেশে ৫ লাখ ইউরোর বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের অধিবাসীদের থাকার অধিকার দেওয়া হতো। এসব স্কিমের সবচেয়ে বেশি সুবিধা নেয় রাশিয়া ও চীনের ধনীরা। স্কিমগুলোর অধীনে ৯০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ সম্পত্তি খাতে গেছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে বাড়িভাড়া ও বাড়ির দাম বেড়ে গেছে। স্থানীয় মানুষেরা এর বিরোধিতা করার কারণেই স্পেন সরকার এই কর্মসূচি বাতিল করতে চলেছে।
আরও বেশ কয়েকটি দেশ এসব কর্মসূচি বাতিল করেছে, যেমন আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন। অন্যদিকে আছে অস্ট্রেলিয়া।
মূলকথা হলো, বিনিয়োগের বিনিময়ে অভিবাসনের বাজার সংকুচিত হচ্ছে। এর অর্থনৈতিক সুবিধা বা প্রাপ্তি আছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে সরকার ভাবছে, এই অর্থনৈতিক সুবিধা রাজনৈতিক ও অন্যান্য মাশুলের চেয়ে বেশি কি না। অর্থের বিনিময়ে এখনো অনেক দেশের ভিসা ও পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব। তবে ধনীদের এ ক্ষেত্রে লাগামছাড়া হওয়ার সুযোগ কিছুটা কমে এসেছে।