দেশে দিন দিন শিল্পায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে রাসায়নিক আমদানির পাশাপাশি তা উৎপাদনে দেশেও নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠছে। একই সঙ্গে শিল্পকারখানায় রাসায়নিক ব্যবহার ও সরবরাহজনিত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় বিপজ্জনক রাসায়নিকের পুরো সরবরাহব্যবস্থায় নিরাপত্তা বাড়ানো দরকার।
চট্টগ্রাম ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোয় (আইসিডি) অগ্নিদুর্ঘটনা ও শিল্পনিরাপত্তা বিষয়ে আজ বুধবার এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব কথা বলেন। সিপিডি ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ যৌথভাবে এ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার নুজহাত জেবিন ও সিপিডির গবেষণা ইন্টার্ন জেবুন্নেসা জেবা।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এক দশক ধরে দেশে রাসায়নিক দুর্ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু রাসায়নিকজনিত দুর্ঘটনা দেখভাল করার জন্য যে ধরনের নিরাপত্তাকাঠামো দরকার, তা আমাদের নেই। রাসায়নিক উৎপাদন থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানির বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা নিরাপত্তাকাঠামো অপর্যাপ্ত ও অসম্পূর্ণ। এর ফলে শিল্পঝুঁকি ও মৃত্যুঝুঁকি দুটোই বাড়ছে।’
তৈরি পোশাক খাতের দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক কাজ হলেও রাসায়নিক শিল্পে দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব আছে বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘আমাদের যেসব বিদ্যমান আইন রয়েছে, তার মধ্যে দাহ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিধিবিধানের ঘাটতি আছে। এ পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান যুক্ত। কিন্তু তারা যে যার কাজটুকু করেই দায় সারে। ফলে কোনো একটি পর্যায়ে দুর্বলতা থেকে গেলে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। যেমনটা আমরা চট্টগ্রামের ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) দুর্ঘটনায় দেখতে পেয়েছি।’ সে জন্য তিনি একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
গত ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) একটি কনটেইনারে আগুন লাগার পর তা আশপাশের শেড ও কনটেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৯ জন নিহত ও দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন।
আইসিডি দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমরা সরেজমিনে ওই ডিপোতে গিয়েছি। সেখানে স্বাভাবিক পণ্য মজুতের অনুমোদন থাকলেও রাসায়নিক রাখার অনুমোদন ছিল না। পাশাপাশি রাসায়নিক দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণও ছিল না সেখানে। সবচেয়ে বড় বিষয়, এসব দুর্বলতা দেখা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁদের তৎপরতায় ঘাটতি ছিল।’
রপ্তানি পণ্য হিসেবে আইসিডি ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কনটেইনারগুলো রাখা হয়েছিল। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শুধু রপ্তানি পর্যায়ে নয়, আমদানি পর্যায়েও এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বরং আমদানি পর্যায়ে এ দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি। বেসরকারি এসব ডিপোর পাশাপাশি বন্দরের নিরাপত্তা কেমন আছে, তা–ও যাচাই করার পরামর্শ দেন তিনি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘রানা প্লাজা ও তাজরীন গার্মেন্টসে দুর্ঘটনার পরে আমরা তৈরি পোশাক খাতে কমপ্লায়েন্সের অনেক উন্নতি দেখেছি। এখন সময় হয়েছে রাসায়নিকসহ অন্য সব শিল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। শ্রমিকদের জীবনমানের পাশাপাশি তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। তা না হলে শক্তিশালী শিল্প খাত তৈরি করা সম্ভব হবে না।’
আইসিডি দুর্ঘটনার জন্য বিদেশি ক্রেতাদেরও প্রশ্ন করা দরকার বলে মনে করেন ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার নুজহাত জেবিন। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের ক্রেতারা পুরো সরবরাহব্যবস্থায় নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে পণ্য ক্রয় করেন। কিন্তু রাসায়নিক পণ্যের ক্রেতারা তা ঠিকভাবে দেখেন কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা প্রয়োজন।