বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কয়লা আমদানি ১০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থবছরের ছয় মাসের মাথায় এসে মোট আমদানি বাড়তে শুরু করেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বর পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল কম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক পণ্যের বেশির ভাগ খাতের আমদানিতেই ছিল ঋণাত্মক প্রবণতা। কিন্তু কয়লা আমদানির ওপর ভর করে ডিসেম্বর মাস থেকে সার্বিক পণ্য আমদানি বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আমদানি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পণ্য আমদানি হয়েছে ৬ কোটি ৬৯ লাখ ৩২ হাজার টন। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬ কোটি ৬৯ লাখ ২৫ হাজার টন। অর্থাৎ দেশে এখন পণ্য আমদানি বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছে।
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমায় আমদানিতে ব্যয় কমার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। যেমন চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৪ হাজার ৩৮১ কোটি ডলার। এক বছরে সার্বিকভাবে আমদানিতে ব্যয় কমেছে ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
মূলত রিজার্ভ কমায় আমদানিতে যে সংকোচনমূলক নীতি নেওয়া হয়েছে, তারই প্রভাবে শিল্পের কাঁচামালসহ নানা খাতের আমদানি কমছে। চাহিদামতো পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না।মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি
কয়লা যেভাবে বাড়াল মোট আমদানি
ডলার-সংকটের পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় এর প্রভাব পড়ে পণ্য আমদানিতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য আমদানির পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কমে যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য আমদানি হয় ৩ কোটি ২৪ লাখ টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৭০ শতাংশ কম।
বর্তমান অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শিল্প খাতে কাঁচামালভেদে আমদানি ৩ থেকে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাতগুলো হচ্ছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, বস্ত্র, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, প্রাণিখাদ্য, জাহাজ নির্মাণ, সমুদ্রগামী জাহাজ, ওষুধ, রাসায়নিক ইত্যাদি। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষেও এসব খাতের পণ্য আমদানি বাড়ার প্রবণতা শুরু হয়নি।
তবে কয়লা আমদানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় মোট পণ্য আমদানিতে ইতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়েছে। দেশে আমদানি করা কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানি হচ্ছে। তাতে কয়লা আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ১০৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। যেমন গত জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে কয়লা আমদানি হয়েছে ৬৭ লাখ ২৫ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল প্রায় ৩৩ লাখ টন। অর্থাৎ এই পণ্যের আমদানি বেড়েছে ৩৪ লাখ টন বা ১০৪ শতাংশ।
শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ঋণাত্মক
কয়লা আমদানি বাড়লেও শিল্প খাতের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি এখনো ঋণাত্মক রয়ে গেছে। বস্ত্র খাতের কাঁচামাল তুলা আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তুলা আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ১৮ হাজার টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯ লাখ ৩ হাজার টন।
প্রাণিখাদ্য সয়াবিনবীজ আমদানি কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সয়াবিনবীজ আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৭ লাখ ৮১ হাজার টন।
সিমেন্ট শিল্পের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানি কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। গত জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে ক্লিংকার আমদানি হয়েছে ৯৫ লাখ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে ১ কোটি ২ লাখ টন আমদানি হয়েছিল।
তবে শিল্প খাতের মধ্যে লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রডশিল্পের প্রধান কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি হয়েছে ২৮ লাখ ১২ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি হয়েছিল ২৩ লাখ ৫৩ হাজার টন। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ২০ শতাংশ। এদিকে আমদানি বাড়লেও চলতি ভরা মৌসুমে এই খাতের বেচাবিক্রি খুব বাড়েনি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
সিমেন্ট ও ভোগ্যপণ্য খাতের দুজন উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে জানান, ডলার-সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে এখনো সমস্যা হচ্ছে। আবার দেশেও চাহিদা খুব বাড়েনি। এ জন্য কারখানা সচল রাখতে যতটুকু কাঁচামাল দরকার, তাঁরা সেটাই আমদানি করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না বাড়লে আমদানি খাতের সংকট কাটবে না।
এখনো অনিশ্চয়তা
দেশে ডলার-সংকট এখনো কাটেনি। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ও বাড়ছে না। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতিনিয়ত কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের একেবারে গোড়ার দিকে গত ৫ জুলাই তাদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৩ হাজার ১১৬ কোটি ডলার। ১০ জানুয়ারি তা নেমে আসে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি ডলারে। এর মানে পাঁচ মাসে রিজার্ভ কমেছে ৬৪৯ কোটি ডলার।
অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী ১০ জানুয়ারি রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ১৮ কোটি ডলার। তবে প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কম।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকায় সামনে আমদানি খুব বেশি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বলে জানান উদ্যোক্তারা। কারণ, আমদানিতে যে কড়াকড়ি চলছে, ডলার-সংকটের কারণে তা শিগগিরই কাটছে না।
রিজার্ভ বাড়াতে হবে
কয়লা আমদানি বেশি বৃদ্ধি পাওয়াতেই মূলত সার্বিকভাবে পণ্য আমদানিতে প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে। তবে কয়লা বাদ দিয়ে হিসাব করা হলে গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি এখনো ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূলত রিজার্ভ কমায় আমদানিতে যে সংকোচনমূলক নীতি নেওয়া হয়েছে, তারই প্রভাবে শিল্পের কাঁচামালসহ নানা খাতের আমদানি কমছে। অর্থাৎ চাহিদামতো পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। আমদানি কমে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ স্তিমিত হয়ে পড়ছে। অর্থনীতিতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। যেমন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। আবার কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব বাড়বে। রিজার্ভ না বাড়লে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না।