তিন মাসের শিশু ঘরে রেখে বেলা সাড়ে ১১টায় সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার আশায় টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইনে দাঁড়ান গৃহিণী নিলুফা আক্তার। সারির ভিড় ঠেলে বেলা দুইটার দিকে কিছুটা সামনে এগিয়ে যান তিনি। এর মধ্যে ভিড়ও বাড়ে। মানুষের চাপে হঠাৎ ধাক্কাধাক্কিতে তিনি ছিটকে পড়েন সারি থেকে। পরে সারিতে দাঁড়িয়ে আর পণ্য পাননি। বেলা তিনটায় শেষ হয় পণ্য বিক্রি। সাড়ে তিন ঘণ্টার অপেক্ষার পরও খালি হাতেই ফিরে গেছেন নিলুফা। ঘটনাটি গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট মোড়ের।
নিম্ন আয়ের মানুষকে বাজারের চেয়ে কিছুটা কম দামে পণ্য দিতে সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সম্প্রতি ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে। গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগরের ৫০টি ও চট্টগ্রাম মহানগরের ২০টি স্থানে এ কার্যক্রম চলছে। এরপর প্রতিদিনই পণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ট্রাকে পণ্য কম থাকায় প্রতিদিনই নিলুফা আক্তারের মতো অনেককে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার কাজীপাড়া, মিরপুর-৬ কাঁচাবাজার, মিরপুর-১০ গোলচত্বর, কালশী ফ্লাইওভার মোড়, ধানমন্ডি খেলার মাঠ, গাবতলী ও শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড এবং চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট ও জামালখান মোড়ে গতকাল সরেজমিনে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর চার প্রতিবেদক। এসব স্থানে পণ্যের তুলনায় ক্রেতার উপস্থিতি ছিল বেশি।
বাজারে নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে অনেক দিন ধরেই হিমশিম অবস্থা গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের। জিনিসপত্রে দাম বাড়তে থাকায় সর্বশেষ অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে আবার ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে পৌঁছেছে। গত এক মাসে বাজারে দাম বেড়েছে চাল, পেঁয়াজ, আলু, ব্রয়লার মুরগিসহ বেশ কিছু পণ্যের। এ কারণে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে।
টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ভোক্তা ২০০ টাকায় সর্বোচ্চ দুই লিটার সয়াবিন তেল, ৩০ টাকা করে ১৫০ টাকায় সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি চাল ও ৬০ টাকা কেজি দরে দুই কেজি মসুর ডাল কিনতে পারেন। সব মিলিয়ে টিসিবির এই তিন পণ্য কিনতে একজন ভোক্তার খরচ হয় ৪৭০ টাকা। যেখানে বাজার থেকে সমপরিমাণ পণ্য কিনতে লাগে প্রায় ৭৫০ টাকা। টিসিবির প্রতিটি ট্রাকে সাড়ে তিন শ জনের জন্য চাল, ডাল ও তেল বরাদ্দ থাকে।
চট্টগ্রামের খাজা রোডের বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী গোলতাজ বেগম গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় জামালখানে টিসিবির লাইনে দাঁড়ান। পণ্য পেয়েছেন বেলা দুইটার দিকে। ভাঙা গলায় প্রথম আলোকে গোলতাজ জানান, তাঁর স্বামী অসুস্থ। ছেলেও বেকার। কোনো রকমে টেনেটুনে সংসার চলছে। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য পেলেন। তাই ক্লান্ত। পরিবারের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, স্বামী ঘর–বসা। বেশ কিছুদিন ধরে কাজে যেতে পারছেন না। আয় নেই। মেয়ের এক জোড়া স্বর্ণের কানের দুল বন্ধক রেখে কিছু টাকা পেয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে বাজার খরচ চলছে। সেখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে টিসিবির পণ্য কিনলেন।
গতকাল দুপুরে পরিচিত একজনের মাধ্যমে মুঠোফোনে টিসিবির ট্রাকের খবর জানতে পারেন গৃহকর্মী সালমা আক্তার। জেনেই গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে ছুটে যান তিনি। তবে পৌঁছে দেখেন টোকেন শেষ। তখন বেলা একটা। প্রথম আলোকে সালমা আক্তার বলেন, ‘কর্ম কইরা খাইতে হয়। কাজ ফালাইয়া আহন যায় না। তবু আজকে কাম রাইখা ছুইটা আইয়া দেহি টোকেন শেষ।’ পরে তিনি আবার কাজে ফিরে যান।
গাবতলীতে টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধি আহাদ মিয়া জানান, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাঁরা সেখানে গেছেন। তখনই অপেক্ষমাণ মানুষের জন্য টোকেন হিসেবে ৩৫০টি কার্ড বিতরণ করা হয়। তবে শুরুতে সেই টোকেন না পেয়ে অনেকে ফিরে গেছেন। অনেকে আবার বিক্রি শুরুর পরে এসে ওই টোকেনের খোঁজ নেন। কিন্তু বাড়তি পণ্য না থাকায় তাঁদের টোকেন দেওয়া হয়নি।
অবশ্য রাজধানীর দু-একটি স্থানে টিসিবির ট্রাকের সামনে লোক ছিল কম। ধানমন্ডি খেলার মাঠ এলাকায় দুপুরে ট্রাকের সামনে ছিলেন ১১ জন নারী ও ১৭ জন পুরুষ। ওই সময় ট্রাকে ১২৫ জনের পণ্য ছিল। মানুষ কম থাকায় যাঁরাই লাইনে ছিলেন, তাঁরা পণ্য পেয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে মিরপুরের কালশী ফ্লাইওভার মোড়ে টিসিবির ট্রাকের পণ্য বিক্রি শেষ হয়। তখনো সেখানে ৯০ জনের মতো পণ্য কেনার আশায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের একজন দিনমজুর ইসমাইল মোল্লা। তিনি বলেন, ‘সারা দিন মজুরি করি। ট্রাক থেকে পণ্য কেনার সময় পাই না। তাই বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমানোর উদ্যোগ নিলেই ভালো হয় আমাদের জন্য।’