পাচারের অর্থ ফেরাতে টাস্কফোর্স পুনর্গঠন, প্রধান গভর্নর

বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করেছে সরকার। আজ রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এবার টাস্কফোর্সকে নতুন করে সাজানো হয়েছে এবং প্রথমবারের মতো এ টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে।

পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য কমিয়ে সভাপতিসহ ৯ জন করা হয়েছে। এত দিন টাস্কফোর্সের জন্য আহ্বায়ক কমিটি ছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। আর কমিটি ছিল ১৪ সদস্যের।

পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; আইন ও বিচার বিভাগ; দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক); পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি); অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে একজন করে উপযুক্ত প্রতিনিধি থাকবেন। উপযুক্ত প্রতিনিধি বলতে কী বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ কোনো সদস্য কোন পর্যায়ের কর্মকর্তার নিচে হবেন না, প্রজ্ঞাপনে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।

নতুন টাস্কফোর্স থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব, এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালককে (বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ)।

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে, আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম কানাডায় অর্থ পাচার করেছেন বলে দুদক তদন্ত করছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

কার্যপরিধি বেড়েছে

নতুন প্রজ্ঞাপনে বাড়ানো হয়েছে টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি। এত দিন কার্যপরিধিতে তিনটি বিষয় থাকলেও এবার করা হয়েছে ছয়টি। এগুলো হলো বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা; পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা ও তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া; বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া; জব্দ বা উদ্ধার সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া; এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আহরণ করা এবং পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী টাস্কফোর্সের কাজ সমন্বয় করবেন। আর টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দেবে বিএফআইইউ। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হবে।

আগেও পুনর্গঠিত হয়েছে, কাজ হয়নি

পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে প্রথম ১০ সদস্যের আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পরে ২০২২ সালের ৫ জুন এর সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ১৪। বরাবরই আহ্বায়ক করা হয় অ্যাটর্নি জেনারেলকে। আর সদস্যসচিব ছিলেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের উপপ্রধান কর্মকর্তা। এত বছর তাঁরা শুধু বৈঠক করেছেন, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেননি। ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি আবার পুনর্গঠন করা হয় এ টাস্কফোর্স।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৭ শতাংশ কর দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যেকোনোরূপে গচ্ছিত অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে এনে আয়কর রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে এ সুযোগ কোনো কাজে লাগেনি, এক টাকাও ফেরত আসেনি।

বিএফআইইউ গত বছর অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে ৪৯ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। ওই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, হংকং, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, কুয়েত, বেলজিয়াম, তানজানিয়ায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের কথা রয়েছে।