অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাজেটে বড় ধরনের নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে পাইপলাইনে থাকা অনেক বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফআইসিসিআই) বা ফরেন চেম্বার।
ফরেন চেম্বার বলছে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি ধারাবাহিকতা অন্যতম পূর্বশর্ত। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি ধারাবাহিকতার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয়। কিন্তু এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে, তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। আজ সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত বাজেট-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে এই আশঙ্কার কথা তুলে ধরে সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাজেটে নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন করে আর কোনো কর অব্যাহতি সুবিধা থাকবে না। আবার সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন কোম্পানি গঠন ছাড়া কর অব্যাহতি সুবিধা পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে কোনো কোম্পানির কার্যক্রম থাকলে এবং নতুন করে তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিলে কর অব্যাহতি সুবিধা পাবে না।
সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শর্তসাপেক্ষে কর অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা হলেও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে এ সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই এ বিধানকে বৈষম্যমূলক মনে করছে ফরেন চেম্বার। এ ছাড়া নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব কোম্পানি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে কেবল তাদের ক্ষেত্রেই শর্তসাপেক্ষে কর অব্যাহতি সুবিধা বহাল থাকবে। এর বাইরে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ, বিদেশি কর্মী নিয়োগ, রয়্যালটির ওপর এত দিন কর অব্যাহতির যে সুবিধা পেত, তা বাতিল করা হয়েছে।
ফরেন চেম্বার বলছে, বর্তমানে বিদেশি একাধিক কোম্পানির অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ পাইপলাইনে আছে। এসব কোম্পানি এরই মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধও হয়েছে। এখন নতুন করে এসব কোম্পানির কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেওয়া হলে তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবে। ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এ সিদ্ধান্ত ভুল বার্তা দেবে।
বাজেট-উত্তর এ সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ফরেন চেম্বারের বক্তব্য তুলে ধরেন সংগঠনটির সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের জাভেদ আখতার। আর বাজেটের খুঁটিনাটি নানা দিক তুলে ধরেন সংগঠনটির করবিষয়ক উপদেষ্টা স্নেহাশীষ বড়ুয়া। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি রূপালী হক চৌধুরী, শেহজাদ মুনীম, পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী। আর অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নুরুল কবির।
টেলিকম খাত ও কার্বোনেটেড ড্রিংকসের ওপর প্রস্তাবিত বাজেটে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে ফরেন চেম্বার। তারা বলছে, কার্বোনেটেড ড্রিংকসে বড় অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। এ অবস্থায় এ খাতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো এবং ন্যূনতম কর ৩ শতাংশ বহাল রাখা হলে বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও ব্যবসায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বাজেটের এই পদক্ষেপে টেলিকম খাতের প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করে ফরেন চেম্বারের নেতারা। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ছোট-বড় ও মাঝারি অনেক উদ্যোক্তা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাঁদের ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছেন। সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির নতুন সিদ্ধান্ত এসব ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দেবে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি পরিবর্তনের বিষয়ে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, কর সুবিধার কারণেই দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ জন্য অনেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ নিয়ে বেজার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এখন কর সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে এসব বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হবে, নতুন বিনিয়োগও আসবে না। তাই এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
এ বিষয়ে ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, যখন কোনো সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণ করার পর সেটি হঠাৎ করে তুলে নেওয়া হয়, তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নীতি বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেকোনো দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেন, তার মধ্যে নীতি বিশ্বাসযোগ্যতা, নীতির ধারাবাহিকতা অন্যতম।
ফরেন চেম্বারের সাবেক সভাপতি শেহজাদ মুনীম বলেন, যেকোনো নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাতিলের ক্ষেত্রে ৫–৭ বছরের নির্দেশনা থাকা উচিত। রাতারাতি নীতি সিদ্ধান্ত বদল করলে তাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময় তিনি করের ক্ষেত্রে ভূতাপেক্ষ শব্দটি বাতিলের দাবি জানান।
সংগঠনটি বলছে, বাজেটে নতুন কাস্টমস আইন, কার্যকর করহার কমানোর উদ্যোগ, প্রগতিশীল বা প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থা (ধনীদের ওপর বেশি কর, গরিবের ওপর কম কর), মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের ক্ষেত্রেও সংস্কারসহ বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে তা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়তা করবে বলে মনে করে ফরেন চেম্বার।