রাজধানীর শনির আখড়া এলাকার ইয়াসমিন হক নবাবপুরের পাইকারি ইলেকট্রিক পণ্যের মার্কেটে এসেছেন চার্জার ফ্যান কিনতে। আজ সোমবার বেলা একটার দিকে বিভিন্ন দোকানে দোকানে ঘুরে চার্জার ফ্যানের দরদাম করছিলেন। কিন্তু পছন্দ হলেও দামে মিলছিল না। কোন ধরনের চার্জার ফ্যান কিনলে ভালো হবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন এই গৃহিণী। সঙ্গে ভাই আসলাম উদ্দিনকেও নিয়ে এসেছেন তিনি।
ইয়াসমিন হক বলেন, ‘লোডশেডিং এতটাই বেড়েছে যে টেকা দায়। আমরা না হয় কষ্ট করে থাকতে পারি, কিন্তু বাসায় বাচ্চাকাচ্চা আছে। তাদের জন্যই বাধ্য হয়ে চার্জার ফ্যান কিনতে এলাম। দুই ঘরের জন্য দুটো ফ্যান কিনেছি। এখানে এলে একটু কমে পাওয়া যায় শুনেছি। তবে আজকে যে দাম দেখলাম, তাতে বাসার কাছের কোনো দোকান থেকে নিলেও এমনই পড়ত।’
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে এই গৃহিণী আরও বলেন, ‘কাল স্থানীয় এক দোকানে দরদাম করেছিলাম। কিন্তু ওই দোকানে একটা মাত্র ব্র্যান্ডের ফ্যান ছিল। এখানে অনেক রকমের ফ্যান পাওয়া যায়। বিদেশি ব্র্যান্ডের দুটো ফ্যান নিলাম, দাম পড়েছে ৮ হাজার করে ১৬ হাজার টাকা।’
নবাবপুর ও গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহের তুলনায় প্রতিটি চার্জার ফ্যানের মান ও আকারভেদে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা বেড়েছে। বেশি বেড়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফ্যান। এসব ফ্যানের দাম পড়ছে চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা। বিক্রেতারা জানান, বেচাকেনাও ভালো। বাজারে ১২, ১৪ ও ১৬ ইঞ্চির চার্জার ফ্যান বেশি চলছে। তবে স্ট্যান্ড ফ্যানের চাহিদাও ভালো।
চার্জার ফ্যান হলো এমন ধরনের ফ্যান, যা বিদ্যুৎ থাকা অবস্থায় চার্জ করে রাখা যায়। যখন বিদ্যুৎ থাকে না, তখন এই ফ্যান চালানো যায়। ফলে দেশে যখন মারাত্মক বিদ্যুৎ-সংকট, এ ফ্যান চালিয়ে তখন মানুষ কিছুটা স্বস্তির পরশ পাচ্ছে।
বিদ্যুতের ঘাটতি থাকায় এবার এয়ারকুলার অবশ্য কম বিক্রি হচ্ছে। গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেটের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এসিও ভালো পরিমাণে বিক্রি হচ্ছে। তবে গতবারের চেয়ে এবার এসির দামও কিছুটা বেড়েছে বলে জানান তাঁরা।
বেলা আড়াইটার দিকে নবাবপুর থেকে ফ্যান কিনে নারায়ণগঞ্জে ফিরছিলেন মো. রহমতুল্লাহ নামের একজন ক্রেতা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি ব্র্যান্ডের একটি চার্জার ফ্যানের দাম নিল সাত হাজার টাকা। গতকাল এই একই জিনিস নারায়ণগঞ্জে সাড়ে ছয় হাজার টাকা নিছিল। আমি ভাবলাম, এখানে এলে কমে পাব। কিন্তু এখানেই দাম বেশি। অবশ্য কাল যেখানে সাড়ে ছয় হাজার বলেছিল, ওনাকে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি বিক্রি করে ফেলেছেন। কাল কিনলে ৫০০ টাকা ঠকতাম না।’
চার্জার ফ্যানের দাম যে বেড়েছে, তা বিক্রেতারা স্বীকার করছেন। স্টেডিয়াম মার্কেটের নারায়ণগঞ্জ ইলেকট্রনিকসের বিক্রেতা হারুন-উর-রশিদ বলেন, গরমের সময় গত বছরও বেশ ভালো সংখ্যায় চার্জার ফ্যান বিক্রি হয়েছিল। এবারও ব্যবসা ভালো।
তবে হারুন-উর-রশিদ বলেন, ‘পাইকারি বাজার থেকেই চার্জার ফ্যান বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আজও প্রতিটি ফ্যানে ২০০ টাকা বাড়তি দিয়ে কিনেছি। কালও প্রতিটা ফ্যানে ২০০ টাকা বাড়তি দিয়েছি। এক সপ্তাহে দাম বেশ বেড়েছে। আমরা যেভাবে কিনছি, সেভাবেই দাম সমন্বয় করে বিক্রি করছি।’
দুপুর ১২টা নাগাদ নবাবপুর এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, গুলিস্তানের মূল সড়ক থেকে পুরো নবাবপুর এলাকায় ছোট ছোট পিকআপ আর মালবাহী ভ্যানে করে ফ্যান ওঠানামা করা হচ্ছে। এসব ফ্যানের অধিকাংশ চার্জার ফ্যান। এসব ফ্যান হয় দোকানে নিয়ে আসা হচ্ছে বিক্রির উদ্দেশ্যে, নয়তো বিক্রির পর ফ্যান নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে চার্জার ফ্যান বিক্রি কোনো কোনো দোকানে দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আমদানিকারকদের কারও কারও বিক্রি আরও বেশি বলেও জানা গেছে।
নবাবপুরের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মেসার্স নিজাম এন্টারপ্রাইজ। নবাবপুরে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি বিক্রয়কেন্দ্র আছে। একটি বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সেখানে কর্মরত এক কর্মচারী বলেন, বেচাকেনা খুব বেশি ভালো নয়, বরাবরের মতোই চলছে।
তবে এরই মধ্যে দেখা গেল, ওই কর্মচারী কয়েক ক্রেতার সঙ্গে কথা বলছেন। কাউকে মালামাল বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আবার ‘চার্জার ফ্যান নেই’ বলে কাউকে কাউকে ফিরিয়ে দিলেন। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নিজামউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
নবাবপুরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গরম বেশি পড়লে আগে ফ্যানের চাহিদা বাড়ত। তবে এখন গরম বেশি পড়ার সঙ্গে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করছে। ফলে চার্জার ফ্যানের চাহিদা বেড়েছে। এতে পণ্যের সংকট তৈরি হয়েছে এবং দামও বেড়েছে। তবে বড় আমদানিকারকদের কাছে এখনো পণ্য আছে।
দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠানও এখন চার্জার ফ্যান তৈরি করে থাকে। ফলে আগে এ বাজার পুরোপুরি আমদানিনির্ভর থাকলেও এখন তা অনেকটাই কাটতে শুরু করেছে। এরপরও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হওয়ায় বাজারে প্রতিযোগিতা কম। বিক্রেতারা জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যে দামে চার্জার ফ্যান বাজারে ছাড়ে, সেই দামেই কিনতে হয়। এখন গরম বেশি পড়ায় আমদানিকারকেরা ভালো ব্যবসা করছে। তবে পাইকারি বিক্রেতারা এ নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে রাজি নন।
অবশ্য পাইকারি ব্যবসায়ীরা এটাও বলেছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি খোলার জটিলতার কারণে আমদানি খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে গরম বেশি পড়ার কারণে সংকটকে পুঁজি করে দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
নবাবপুর এলাকায় ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রি করে এমন ছোট-বড় প্রায় ৪১টি ভবন রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা। এসব দোকানে পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রি করা হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, গরমকালে এমনিতে ফ্যান বিক্রি বাড়ে। এ বছর লোডশেডিংয়ের কারণে চার্জার ফ্যানের চাহিদাই বেশি বেড়েছে।
নবাবপুরের মোহন ইলেকট্রিক মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মূলত সিলিং ফ্যানের ব্যবসা। সাথে চার্জার ফ্যানও রাখি। তবে চার্জার ফ্যানের ব্যবসা একেবারে সাময়িক সময়ের জন্য হয়। সিলিং ফ্যানের ব্যবসা হয় বছরব্যাপী। কারণ নতুন ভবন হলেই সেখানে ফ্যানের দরকার হয়। কিন্তু শুধু গরম পড়লেই দেখা যায়, চার্জার ফ্যানের কদর বাড়ে। গুদামে জায়গাও নেয় বেশি। এ জন্য সবাই এই ফ্যান বেচে না। এ জন্য এসব পণ্যের চাহিদা বাড়লে দামও দ্রুত বেড়ে যায়।’
এদিকে গরম বাড়ার কারণে শুধু যে বিপণিবিতানগুলোতে ফ্যানের বেচাকেনা বেড়েছে, তা-ই নয়, ফুটপাতের অনেক দোকানেও বিক্রি হচ্ছে ছোট চার্জার ফ্যান। অনেকে মুঠোফোনের সঙ্গে ব্যবহার করা যায়, এমন ছোট ফ্যানও কিনছেন। নবাবপুর ছাড়াও গুলিস্তানের ফুটপাত ও বায়তুল মোকাররমের আশপাশের এলাকায় এসব পণ্য ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গুলিস্তানের হকার নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘যখন যে পণ্য মানুষ কিনত চায়, আমরা সেটাই তখন বিক্রি করি। যেমন গরম এলে ফ্যান। আবার শীত এলে জ্যাকেট।’