ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়ে গত এক যুগে আলোচনা, পথ নির্ধারণ, মাশুল নির্ধারণ, পরিচালনা নীতিমালা—সবই হয়েছে। কিন্তু পণ্যের আসা-যাওয়া কম।
ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়ে গত এক যুগে আলোচনা, পথ নির্ধারণ, মাশুল নির্ধারণ, পরিচালনা নীতিমালা—সবই হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন পথে পরীক্ষামূলক চালানও গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রানজিট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। কোনো পথেই ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের চালান নিয়মিত হয়নি।
ট্রানজিটের সর্বশেষ সংযোজন হলো, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভূখণ্ড হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য আনা-নেওয়া করা। গত এপ্রিল মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আটটি পথ নির্ধারণ করে মাশুল ঠিক করেছে। স্থায়ী আদেশও জারি করা হয়। কিন্তু তিন মাসে এই পথে কোনো পণ্য আসা-যাওয়া করেনি।
সম্প্রতি ভারতের পিটিআইয়ের এক সংবাদে বলা হয়েছে, ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী সান্ত্বনা চাকমা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে চারটি পথে পণ্য আনা-নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই পথ ব্যবহার করতে পারবেন। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর ভারতের ট্রানজিট নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতের ব্যবসায়ীরা ট্রানজিটের বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
শুধু অনুমোদন দিলেই হবে না। পণ্যের চালানের চলাচল মসৃণ করতে অবকাঠামো সুবিধা ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। এগুলো হয়নি।মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
কেন ট্রানজিটে আগ্রহ নেই, জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু অনুমোদন দিলেই হবে না। পণ্যের চালানের চলাচল মসৃণ করতে অবকাঠামো সুবিধা ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।
এগুলো হয়নি। ভারতের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য নিতে অবকাঠামো সুবিধাসহ খরচ ও সময় বিবেচনা করবেন। এ ছাড়া ভারতের ব্যবসায়ীরা ‘চিকেন নেক’ দিয়ে পণ্য পরিবহন করলে পরিবহন খরচে বিশেষ ভর্তুকি সুবিধা পান। ওই পথে তাঁদের খরচ কম হলে বাংলাদেশ দিয়ে আসতে আগ্রহ দেখাবেন না।
এদিকে এনবিআর ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রানজিটের পণ্যের চালানের সীমান্ত পাড়ি দিতে সব সুবিধাই নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন ভারতের ব্যবসায়ীদের ট্রানজিট ব্যবহার বাড়াতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা দরকার।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য নেওয়ার উদ্যোগও আলোর মুখ দেখছে না। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রথম পরীক্ষামূলক চালান যায়। এরপর কয়েকটি চালান গেছে। গত এপ্রিল মাসে এই দুই পথ নিয়মিত করা হয়। কিন্তু গত তিন মাসে একটি চালানও যায়নি।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে চারটি স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্যের চালান নেওয়া যাবে। এই চার স্থলবন্দর হলো আখাউড়া, বিবিরবাজার, তামাবিল ও শেওলা।
বন্দর দিয়ে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট হলে ডকুমেন্ট প্রসেসিং মাশুল প্রতি চালানে ৩০ টাকা, প্রতি টনে ট্রান্সশিপমেন্ট মাশুল ২০ টাকা, নিরাপত্তা চার্জ প্রতি কনটেইনারে ৮৫ টাকা, প্রশাসনিক চার্জ প্রতি টনে ১০০ টাকা, কনটেইনার স্ক্যানিং চার্জ ২৫৪ টাকা। এ ছাড়া সড়ক ব্যবহার মাশুল ও ইলেকট্রিক লক অ্যান্ড সিল মাশুলও আরোপিত হবে। প্রতিটি মাশুলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটও দিতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের আওতায় নৌ ও সড়ক পথে বহুমাত্রিক ট্রানজিট চালু আছে। কলকাতা থেকে নৌপথে আশুগঞ্জ, পরে সড়ক পথে আখাউড়া হয়ে আগরতলা—এই হলো বহুমাত্রিক ট্রানজিটের পথ। ২০১১ সালে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি বিশেষ ব্যবস্থায় এই পথে নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কয়েক বছরের দর-কষাকষি শেষে মাশুলসহ ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয় ২০১৬ সালে। কিন্তু গত ৭ বছরে ২০-২৫টি চালান গেছে এই পথে। খুব একটা মাশুলও পাওয়া যায়নি। এই পথে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এখন আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগেই কলকাতা থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়ে গেছে। আগে ত্রিপুরার ধর্মনগর পর্যন্ত রেলপথ ছিল। এখন আগরতলা ছাড়িয়ে সাবরুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে কলকাতা থেকে রেলপথে সরাসরি আগরতলায় ভারী পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে একযোগে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা বিবিআইএন নামে পরিচিত। বিবিআইএনের আওতায় ২০১৫ সালের জুন মাসে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চার দেশের মধ্যে অবাধ মোটরযান চলাচল চুক্তি হয়। ভুটান ছাড়া সব দেশ তাতে অনাপত্তি দিয়েছে।
অবাধ মোটরযান চলাচল চুক্তির আওতায় পরীক্ষামূলক যাত্রা হিসেবে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড হয়ে আখাউড়া দিয়ে আগরতলা যায় ভোডাফোন কোম্পানির যন্ত্রাংশের চালান। আলাদা কোনো মাশুল আরোপের সুযোগ না থাকায় প্রতীকী এক রুপি মাশুল আদায় করা হয়েছিল ওই সময়। এরপর আর কোনো চালান যায়নি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে গত বছর কয়েকটি নতুন নৌপথ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে একটি পথ হলো দাউদকান্দি থেকে গোমতী নদী দিয়ে কুমিল্লা হয়ে ত্রিপুরার সিপাইজলা জেলার সোনামুড়া পর্যন্ত নৌপথে; পরে সেখান থেকে সড়ক পথে আগরতলা। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে এই পথে পরীক্ষামূলকভাবে একটি সিমেন্টের চালান গেছে। কিন্তু নাব্যতাসংকট থাকায় এই পথে আর পণ্য নিতে আগ্রহ দেখাননি ব্যবসায়ীরা।