রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০২২ সালে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার আছে এমন দেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্য ১৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৯৩০ কোটি পাউন্ড মূল্যের জীবাশ্ম জ্বালানি কিনেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক খবরে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস কেনা বন্ধের সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে কর্তৃত্ববাদী দেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্য তেল-গ্যাস কেনা বেড়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়া, বাহরাইন, কুয়েত, লিবিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ব্রিটেনের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস (ওএনএস) যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা বিশ্লেষণ করে ডিস্মগ এ কথা জানিয়েছে।
রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে যুক্তরাজ্য সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ঝুঁকছে। গত মাসে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যমন্ত্রী কেমি বাডেনখ মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করা।
মূলত গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসিভুক্ত দেশ যেমন বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তাঁর এ সফর। ২০২২ সালে এই জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য হয়েছে ৬১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ১৩০ কোটি পাউন্ডের।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেন, যুক্তরাজ্য সস্তা পণ্য ও জ্বালানির জন্য কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
ইউক্রেনে হামলা চালানোর আগে রাশিয়া থেকে ৬০ কোটি পাউন্ডের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করত যুক্তরাজ্য। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে তা একদম শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। কিন্তু এর বিপরীতে কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলো থেকে আমদানি বাড়াতে হয়েছে ৬০ শতাংশের বেশি।
গত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম যুক্তরাজ্যের জ্বালানি আমদানি ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে যায়।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি ইনস্টিটিউটের নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে বিশ্ববাসীকে কয়লা, তেল ও গ্যাস ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে হবে। সে লক্ষ্যে বৈশ্বিক জ্বালানি ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
গার্ডিয়ানের সংবাদে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য কাতার থেকে ৬৯০ কোটি ডলার, কুয়েত থেকে ২৬০ কোটি ডলার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৫০ কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করেছে।
তবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির মধ্যে ভূরাজনীতির গন্ধও পাচ্ছেন বিশ্লেষকেরা। জিসিসির কাছ থেকে তেল কিনলে তাদের পশ্চিমের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায়, তাদের চীনের দিকে ঝোঁকা বন্ধ করা যায়। এরপরও মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বলয় কেবল বড়ই হচ্ছে।
মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল উইটনেসের ডমিনিক কাভাকেভ বলেন, রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো একটি প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু এটাই সবকিছু নয়। তাঁর কথায়, ‘রাশিয়া থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে অন্য কর্তৃত্বপরায়ণ দেশ থেকে তা আনা দূরদর্শী কোনো পদক্ষেপ নয়। এটা এক রকমের ভণ্ডামি।’
ডমিনিক কাভাকেভ বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি সব জায়গায় একনায়ক ও যুদ্ধবাজদের পয়সা বানানোর মাধ্যম। এমন একটা জ্বালানিব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, যা পরিবেশ ধ্বংসকারী, তেল বেচে পয়সা বানানো দেশ কিংবা স্বৈরাচারীদের নয়; বরং মানুষ ও ধরিত্রীকে সুফল দেবে।
চলতি বছরে কপ ২৮ অনুষ্ঠিত হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি–সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড বাড়ানোর কারণে তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে। আরও সমালোচনা হচ্ছে আবুধাবি জাতীয় তেল কোম্পানির প্রধান সুলতার আল জাবেরকে জলবায়ু সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট বানানোর কারণে।
আল জাবের সম্প্রতি বলেছেন যে জীবাশ্ম জ্বালানি ‘অদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত একটি ভূমিকা’ পালন করে যাবে। জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক প্রধান ক্রিস্টিনা ফিগেরেস এই বক্তব্যকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বলে বর্ণনা করেছেন। আমিরাত থেকে যুক্তরাজ্যের তেল আমদানি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির ৮ কোটি ৪৪ লাখ পাউন্ড থেকে বেড়ে এক বছর পর ১৯ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডে দাঁড়িয়েছে।
আরব আমিরাতের রাজতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিবাদকারী, শিক্ষক ও আইনজীবী কথা বলছেন, তাঁরাই গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া নারী, সমকামী ও অভিবাসীরা দেশটিতে কর্তৃপক্ষের থেকে বৈষম্যের মুখেও পড়ছেন।
সৌদি আরব হলো যুক্তরাজ্যের আরকেটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি উৎস। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটি থেকে ব্রিটেন পাঁচ কোটি পাউন্ডের তেল আমদানি করেছিল। এক বছর পর আমদানি পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ কোটি ৩৮ লাখ পাউন্ড।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে যে সৌদি আরবে যখন-তখন বিধিবহির্ভূত আটকের ঘটনা ঘটছে। দেশটিকে একটি ‘কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের নিদের্শক’ হিসেবে বর্ণনা করে পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, আটক ব্যক্তিরা নির্যাতন, অবহেলা, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা ও নির্জন কারাবাসের শিকার হন।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৫ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশটিতে রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণকারীদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছর সেখান গড়ে ১২৯ জনকে হত্যা করা হচ্ছে বলেও খবরে জানানো হয়েছে।