এবার রোজায় খরচ বাড়বে

  • ডলার–সংকটে নভেম্বর-ডিসেম্বরে আমদানির ঋণপত্র কম খোলা হয়েছিল।

  • জানুয়ারিতে ঋণপত্র বেড়েছে।

  • সময়মতো পণ্য এলে সরবরাহে সংকট হবে না, বলছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশে গত বছর রোজা শুরু হয় ৩ এপ্রিল থেকে। ওই সময় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। সেই ছোলা এখন প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ।

ছোলার চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে পবিত্র রমজান মাসে। দেড় মাস পর রোজা শুরু হবে। বাজার পরিস্থিতি বলছে, এবারের রোজায় দেশের মানুষকে ছোলা কিনতে হবে আগের চেয়ে অনেকটা বেশি দামে। কারণ দুটি—ছোলার আমদানি ব্যয় বেশি এবং সরবরাহ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। শুধু ছোলা নয়, একই চিত্র ভোজ্যতেল, চিনি, আটার মতো বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ও আমদানির উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত নিত্যপণ্য আমদানি পরিস্থিতি ততটা সন্তোষজনক নয়। তবে গত মাস, অর্থাৎ জানুয়ারিতে আমদানির ঋণপত্র বা এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) বেড়েছে। এসব পণ্যের একটি অংশ রোজার আগে দেশে চলে আসবে। ফলে চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য থাকবে। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে অনেক বেশি সরবরাহ থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে কারসাজির আশঙ্কা থাকে। তাই নজরদারি বেশি প্রয়োজন।

নিত্যপণ্য আমদানিকারক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রোজায় পণ্যের সরবরাহে সমস্যা হবে না। দু-একটি পণ্যের আমদানি এখনো কম। তবে সরবরাহ বাড়ানোর সময় আছে।

চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি

রোজায় চাহিদা বাড়ে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও খেজুরের। এর বাইরে চাল ও আটার চাহিদা সব সময়ই থাকে। চাল বাদে বাকি পণ্যগুলোর চাহিদার বেশির ভাগ মেটানো হয় আমদানি করে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে বছরে ১৮ লাখ মেট্রিক টনের মতো সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা আছে। রোজার বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদা সাড়ে তিন লাখ টনের মতো। তেল সাধারণত অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করে পরিশোধন করা হয়। আবার বীজ আমদানি করে তেল উৎপাদন করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

তেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপণ্যের দাম এখন গত রোজার চেয়ে বেশি। এবার এখন পর্যন্ত আমদানি কম।

দেশে গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি তিন মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টন, যা এক বছর আগের একই মাসগুলোর তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম। সয়াবিন বীজ আমদানি ৮৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ টনে (বীজ থেকে ১৫ শতাংশের মতো তেল পাওয়া যায়)। একই সময়ে পাম তেল আমদানি ৪২ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৪ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত জানুয়ারি মাসে ভোজ্যতেল আমদানির ঋণপত্র খোলা বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ভোজ্যতেলের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার টন, এ বছর তা ৩৮ হাজার টন বেড়েছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছরের রোজায় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৫৮ থেকে ১৭০ টাকা, যা এখন ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম গত এক সপ্তাহে বাড়েনি। তবে পাম সুপার তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা বেড়ে সর্বনিম্ন ১৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের রোজায় অবশ্য পাম তেলের আরও বেশি ছিল।

দেশে বছরে চিনির চাহিদা সাড়ে ২৪ লাখ টনের মতো। রোজায় ৩ লাখ টন চিনি প্রয়োজন হয়। বিগত তিন মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৮২ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ হাজার টন কম। জানুয়ারি মাসে ৫ লাখ ৬৬ হাজার টন চিনি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ৫৫ হাজার টন বেশি।

বাজারে চিনির দাম বাড়ছে। সরকার চিনির দাম প্রতি কেজি ১০৭ টাকা ঠিক করে দিলেও বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। গত বছর রোজায় চিনির প্রতি কেজির দর ছিল ৮০ টাকার নিচে।

ছোলার আমদানি কমেছে। বিগত তিন মাসে আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। মটর ডালের আমদানি কমেছে ১৮ শতাংশ। তবে মসুর ডালের আমদানি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে মটর ও এ–জাতীয় ডাল আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঘাটতি হবে না। যতটা ঋণপত্র হয়েছে, ততটা আমদানি হলেও চাহিদা মেটানো যাবে।

বাজারে আটা-ময়দার দাম যেমন চড়া তেমনি গম আমদানি কম। গত তিন মাসে গম আমদানি ২৫ শতাংশ কমে ১৬ লাখ টনে নেমেছে। বাজারে এখন এক কেজি প্যাকেটজাত আটা ৬৫-৬৮ ও ময়দা ৭৫-৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর রোজায় তা ছিল যথাক্রমে ৪২-৪৫ ও ৫৫-৫৮ টাকা।

খেজুরের আমদানি বেশি কমেছে। রোজায় খেজুরের চাহিদা থাকে ৫০ হাজার টনের মতো। বিগত তিন মাসে খেজুর আমদানি হয়েছে প্রায় ২২ হাজার টন, যা এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ শতাংশ কম। অবশ্য জানুয়ারিতে খেজুর আমদানির ঋণপত্র ১৩ হাজার টন বেড়ে ২৯ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে নভেম্বর মাসের দিকে সাধারণ খেজুরের দাম কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বেড়ে যায়। আর ভালো মানের খেজুরের দাম বেড়েছে প্রতি কেজি ২৪০ টাকা পর্যন্ত। টিসিবির হিসাবে, ঢাকার বাজারে গত বছর রোজায় প্রতি কেজি সাধারণ খেজুর বিক্রি হয়েছিল ১৫০–৩৫০ টাকায়। এখন তা ১৫০–৪৫০ টাকা।

রোজার আগে আসবে তো?

এবার আমদানি কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ ডলার–সংকট। ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী আমদানির ঋণপত্র খুলছিল না। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়। সরকারের কয়েকটি সংস্থার তদারকিতে জানুয়ারিতে ঋণপত্র খোলা বাড়ে।

চট্টগ্রামের খেজুর আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি নির্দেশনার পর ব্যাংকগুলো জানুয়ারিতে ঋণপত্র খুলেছে। এই খেজুরের একটি অংশ রোজার আগে আসবে। একটি অংশ আসবে রোজার মাঝামাঝিতে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে এবং হবে তার বড় অংশ রোজার বাজারে বেচাকেনা হবে। জানুয়ারি মাসে যেসব পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে, সেগুলো রোজার আগে দেশে আনা ও বাজারজাতে তিনটি আশঙ্কার দিক রয়েছে—

১. উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। তা–ও পণ্যের মজুত তৈরি থাকা সাপেক্ষে। ওই দুই অঞ্চলের দেশ থেকে সয়াবিন তেল, চিনি ও ডাল আমদানি হয়।

২. ঋণপত্র খোলার পর মার্কিন ডলারে আমদানিমূল্য পরিশোধে বিদেশি ব্যাংকের নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলে সংকট তৈরি হবে। তখন পণ্য হাতে পেতে বিলম্ব হতে পারে। গত মাসে ঋণপত্রের জটিলতায় পাঁচটি জাহাজের পণ্য বিলম্বে খালাস করতে হয়েছে।

৩. আমদানির পর কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দরকার। গত বছরের শেষের দিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে কারখানায় পণ্য উৎপাদন কমে যায়। ফলে বাজারজাতে বিঘ্ন ঘটে।

বিশ্ববাজারে দাম কম, তবে...

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তবে বাজারের উত্তাপ এখন কমে এসেছে। দাম কমার তালিকায় আছে সয়াবিন তেল, পামতেল, মসুর ডাল, ছোলা ও চিনি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ১ হাজার ৯০০ ডলার ছিল। এখন তা ১ হাজার ৪০০ ডলারের নিচে নেমেছে।

বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, দেশে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণ দুটি—ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে করভার বেড়ে যাওয়া। গত মে মাসে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা ১০৬ টাকা। কর আদায়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম প্রভাব ফেলে। দাম যত বেশি হয়, করভার তত বাড়ে। যেমন ডলারের দাম বাড়ায় চিনিতে কেজিপ্রতি ৮ টাকার মতো বাড়তি শুল্ক দিতে হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্বাভাবিক সময়ের মতো বেশি পরিমাণে রোজার পণ্য আমদানির সক্ষমতা এখন নেই। তবে রোজার আগে যেসব পণ্য আমদানি হচ্ছে, তা যেন বাজারজাত অব্যাহত থাকে, সেদিকে নজর রাখা উচিত। তিনি বলেন, কেউ যাতে বেশি দাম পাওয়ার আশায় পণ্য মজুত করতে না পারে, সেটা তদারকি করতে হবে। তাহলে দাম বাড়ার প্রবণতা ঠেকানো যেতে পারে।