মানুষ যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করে, তার আয়ও তত বেশি। একইভাবে সামাজিক দক্ষতা উন্নয়নের সঙ্গেও মানুষের আয়ের সম্পর্ক আছে। সে জন্য শিক্ষার মতো সামাজিক দক্ষতা রপ্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ধৈর্য ও আত্মসংযমও জীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যাদের ধৈর্য কম, তারা বেশি পড়াশোনা করতে পারে না।
সামাজিক দক্ষতা অর্জনের শিক্ষা যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল বা কার্যকর। এটা শুরু করার সবচেয়ে আদর্শ সময় হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণি, অর্থাৎ ছয়-সাত বছর বা বড়জোর আট বছর। অনেক সামাজিক দক্ষতা এর পরে শেখানো যায় না।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলা হয়। গতকাল দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএসের কার্যালয়ে ‘সামাজিক-আবেগীয় দক্ষতা তৈরি ও শিক্ষাগত অর্জনে তার প্রভাব’ শীর্ষক এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শ্যামল চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে শ্যামল চৌধুরী বলেন, মানুষের সামাজিক-আবেগীয় দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন সময় বা বয়স বেশি সংবেদনশীল, তা নিরূপণে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ১১টি উপজেলার ১৫০টি গ্রামকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করা হয়। সেখানকার ৩ হাজার ২২২ জন শিক্ষার্থীর ওপর একটি জরিপ করা হয়। মূলত শিক্ষকদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ২৮ সপ্তাহব্যাপী প্রতি সপ্তাহে এক দিন ৩০ মিনিটের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সামনে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি উপস্থাপন করেন। এসব পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যৌথ আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দলগতভাবে কাজ বা ওয়ার্ক করতে বলা হয়।
শ্যামল চৌধুরী জানান, মূলত তিনটি সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রভাব নিরূপণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো ধৈর্য, আত্মসংযম ও পরার্থপরতা। যারা পরার্থপর হয়, তারা দলের জন্য কাজ করে; সমাজে বসবাস করতে হলে এই বিষয়টি জরুরি। আর ধৈর্য ও আত্মসংযম শুধু চাকরির ক্ষেত্রে নয়, জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগে। যাদের ধৈর্য নেই, তারা বেশি পড়াশোনা করতে পারে না। সঞ্চয় ও বিনিয়োগে পিছিয়ে থাকে; এমনকি তারা তাড়াতাড়ি মারা যায়। প্রশিক্ষণের পর দেখা গেছে, সামাজিক দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষিত শিশুরা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। পাশাপাশি শিক্ষা অর্জনেও তারা ভালো করেছে।
এই পর্যায়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, এই যে ফলাফল পাওয়া গেল, তার কতটা আত্মসংযমের কারণে হয়েছে; কতটা ধৈর্যের কারণে হয়েছে, সে বিষয়ে কাজ হয়েছে কি না বা কাজ করা হচ্ছে কি না। তিনি আরও বলেন, এই তিনটি সামাজিক দক্ষতার সঙ্গে সততা যোগ করা যেত।
জবাবে শ্যামল চৌধুরী বলেন, এ রকম কাজ তাঁর জানামতে এখনো হয়নি বা তিনিও সে রকম কিছু করছেন না। কেউ চাইলে তার রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারেন, এর জন্য নমুনা হয়তো আরও কিছুটা বেশি লাগবে, কিন্তু বিষয়টি অসম্ভব নয়।
বিআইডিএসের গবেষক কাজী ইকবাল বলেন, এ ধরনের কাজের পর দেখা উচিত, ওই শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে কতটা প্রভাব পড়েছে; গবেষণার চার-পাঁচ বছর পর তা নিরূপণে আরেকটি জরিপ করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রভাব কি কেবল সেই সময়ের জন্য পড়েছিল, নাকি সারা জীবনের জন্য।
এ প্রসঙ্গে বিনায়ক সেন বলেন, মায়ের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ির পরিচারকদের শাসনে বড় হয়েছেন। বলা হয়, সেই শাসনে তিনি মানুষ হয়েছেন। এই যে বলা হলো, কম বয়সেই এই শিক্ষা দরকার, রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যদিও নজরুলের সেই বয়স সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানা যায় না। আরেকটি বিষয় হলো শৃঙ্খলা; রবীন্দ্রনাথও পরিচারকদের দ্বারা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকেছেন। তিনি ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। ফলে তাঁর দিকে তাকানোর মতো কেউ ছিল না। সেনসিটিভি পিরিয়ড বা সংবেদনশীল কালপর্বের কথা বললেন শ্যামল চৌধুরী; সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিঃসঙ্গ, যদিও আত্মসংযম শিখেছিলেন তিনি। ধৈর্যও নিশ্চয়ই শিখেছিলেন সেখান থেকে। কারণ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে বসে থাকতে হয়েছে, আবদার শোনার মতো কেউ ছিল না। পরার্থপরতা কোত্থেকে শিখেছেন, বলতে পারব না।’
বিনায়ক সেন আরও বলেন, কাজী ইকবালসহ সবার কথায় একটি বিষয় উঠে এসেছে; সেটা হলো, এরপর কী। তবে আমরা জানি, যাদের সামাজিক-আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা উন্নত, তারা চাকরিবাকরিতে ভালো করে।
জবাবে শ্যামল চৌধুরী বলেন, এর উত্তর কিছুটা টেকনিক্যাল। বিষয়টা হলো তাঁরা যে চৌহদ্দির মধ্যে গবেষণা করেছেন, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিরূপণের সুযোগ নেই। সে জন্য সমজাতীয় গবেষণাপদ্ধতির দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে বলে তিনি মত দেন।
অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের গবেষক, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।