দেশের ‘ভাবমূর্তির সংকট হয়েছে’, উদ্ধারে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চায় সরকার

সরকারের দুই মন্ত্রী ও এক উপদেষ্টা বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট ঘটনায় দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে ক্ষুণ্ন হয়েছে, তা কোনোভাবে অস্বীকার করা যাবে না। এখন ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে এই ভাবমূর্তি উদ্ধার করাই হবে সরকারের প্রধান কাজ। এ জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন তাঁরা।

আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা। তাঁরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক এবং এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ বিভিন্ন খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গত সোমবার বিকেলে নিজ কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন অনেক ব্যবসায়ী নিজ নিজ খাতের সমস্যার কথা তুলে ধরার সুযোগ পাননি। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ছয় দিনের মাথায় ব্যবসায়ীদের নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।

মতবিনিময় সভার শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘আমরা একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে চলে এসেছি। এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে যে আমাদের একটা ভাবমূর্তি–সংকট হয়েছে এ ঘটনার পর। এটা মেরামত (রিপেয়ার) করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়।’

চলমান পরিস্থিতিতে দেশের ভাবমূর্তি–সংকটের কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলামও। তিনি বলেন, গত সপ্তাহখানেক সময়ে দেশে-বিদেশে যতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাতে বোঝা গেছে যে দেশের জন্য বড় ধরনের একটা ভাবমূর্তি–সংকট হয়েছে। এখন এটা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। কাউকে দোষারোপ করে সমস্যার সমাধান হবে না। এ জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে যেতে হবে।

বর্তমানে দেশ ‘একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে’ বলে সভায় মন্তব্য করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সবাইকে আহত ও ব্যথিত করেছে। শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বহির্বিশ্বেও এটা ছড়িয়ে গেছে। এটা এখন আমাদের সবার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। চলমান পরিস্থিতিতে কোন খাতে কী সমস্যা হয়েছে এবং কত দ্রুত আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারি, তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার।’

এ ছাড়া চলমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন খাতের কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার একটা সম্ভাব্য হিসাব আজকের (রোববার) মধ্যে দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ী নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানান সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, আনুমানিক হিসাব পেলে সেটির আলোকে সরকার কাজ করবে।

ইন্টারনেট নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ

দেশে দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ বা সীমিত থাকায় নানা ভোগান্তি নিয়ে সভায় কথা বলেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া বন্দরের পণ্য ও কনটেইনার–জট, আমদানি-রপ্তানি পণ্য খালাসে বিলম্বের জন্য বাড়তি মাশুল দেওয়া, বাড়তি সুদহার, ডলারের বাড়তি দাম, বাড়তি হারে শুল্ক-কর আদায়, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস না পাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে সমস্যার কথা তুলে ধরেন তাঁরা।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, যত দ্রুত সম্ভব ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সম্পূর্ণ সচল করা প্রয়োজন। বর্তমানে যেটা চালু আছে, সেটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানাকে কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়, তা দেখা প্রয়োজন। এ ছাড়া টাকার অবমূল্যায়নসহ অন্য বিষয়গুলো নিয়েও কাজ করতে হবে।

দেশের ভাবমূর্তির সংকট নিয়ে কথা বলেন মাহবুবুল আলমও। তিনি আগামী পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান। মাহবুবুল আলম বলেন, ‘ঠিক সময়ে বেতন দিতে পারলে তা দেশে-বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি বাড়াতে সহায়ক হবে। আর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা না গেলে দিন শেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’

পাঁচ বিষয়ে কাজ করা হবে

উপদেষ্টা, দুই মন্ত্রী ও এফবিসিসিআই সভাপতির সূচনা বক্তব্যের পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁদের প্রায় দুই ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকে অনেক খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের থেকে অনেক পরামর্শ পেয়েছি, যা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে কাজ করব।’

সালমান এফ রহমান জানান, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথমটি চট্টগ্রাম বন্দরসংক্রান্ত। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বন্দরে কনটেইনার–জট রয়েছে; আমদানি-রপ্তানি পণ্য খালাসে বিলম্বের জন্য বাড়তি মাশুল দেওয়া লাগছে। এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের নিয়ে শিগগিরই একটি সভা করা হবে।

উপদেষ্টা বলেন, সভায় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ব্যাংকের সুদহার অনেক বেশি এবং সহজে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ বা পেমেন্ট ডিলের (বিলম্ব) মতো সুবিধাও চেয়েছেন তাঁরা। এসব বিষয়ে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বৈঠক করা হবে বলে জানান সালমান এফ রহমান।

ইন্টারনেট বন্ধ ও সীমিত থাকায় গত কিছুদিনে ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে বৈঠকে আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, প্রচলিত ইন্টারনেট ব্যবস্থার বাইরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিকল্প একটি ইন্টারনেট ব্যবস্থা তৈরি করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে ব্যবসায়ীরা পরামর্শ দিয়েছেন। এটি নিয়ে আমরা কাজ করব।

চতুর্থত, ব্যবসায়ীরা গ্যাস-বিদ্যুতের বেশি দাম ও নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন বলে সালমান এফ রহমান জানান। তিনি বলেন, এসব সমস্যা নিয়ে দ্রুতই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করা হবে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের এনবিআর–সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো নিয়েও পৃথক বৈঠক করা হবে বলে জানান তিনি।