মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাকসহ সড়কে চলাচলকারী সব ধরনের গাড়ি বা যানবাহনের জন্য বিমা করা আবার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। অবশ্য আগেও তা বাধ্যতামূলক ছিল। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে বিধানটি তুলে দিয়ে ঐচ্ছিক করা হয়। সড়ক পরিবহন সংশোধন আইন, ২০২৪-এর খসড়ায় সব যানবাহনের বিমা করার বিধান রাখা হয়েছে।
আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক পরিবহন সংশোধন আইন, ২০২৪-এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন ব্রিফিংয়ে জানান, বিমা না করলে মোটরযানের মালিকদের তিন হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে, খসড়া আইনে এমন ধারা রাখা হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করে বিমাবিষয়ক একটি উপধারা সংযোজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। উপধারাটিতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ৬০(২) ধারার বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে তা হবে একটি অপরাধ এবং এ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
এদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক পরিবহন সংশোধন আইন, ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদনের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই সড়ক পরিবহন আইনের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। আজ (বুধবার) মন্ত্রিসভায় খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে জেনে খুব ভালো লাগছে। এটি বিমা খাতের জন্য ইতিবাচক, আবার যানবাহনের মালিকদের জন্যও ভালো।’
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ধরনের বিধান করার তথ্য জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছিল ২০২৩ সালের মার্চে। এতে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, বিশ্বের কোনো দেশেই বিমা ছাড়া সড়কে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এ নিয়ে এক বছর ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ চিঠি চালাচালি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ১ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় বিমা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিমা না করা কোনো যানবাহন যাতে চলাচল করতে না পারে, সে জন্য নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা দেখব, যথাযথ বিমা ছাড়া সড়কে কোনো যানবাহন যেন না চলে। এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকেই আইন সংশোধনের ভিত্তি হিসেবে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের সড়ক ও মহাসড়কে চলাচলকারী মোটরসাইকেল, গাড়ি, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের মোট যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ ৬১ হাজার ৪১৮।
এদিকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছে, বিমা করা বাধ্যতামূলক না হওয়ায় এসব গাড়ি থেকে প্রতিবছর ৮৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এর মধ্যে কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাবদ ৮৪৯ কোটি টাকা এবং স্ট্যাম্প ডিউটি ২৮ কোটি টাকা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো সারসংক্ষেপে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একটি বিশ্লেষণ ছিল সড়ক পরিবহন আইনের ওপর। এতে বলা হয়, সড়ক পরিবহন আইনের ৬০(১) উপধারায় যানবাহনের যাত্রীর জন্য বিমা বাধ্যতামূলক রাখার পরিবর্তে ঐচ্ছিক করা হয়েছে। আবার ৬০(২) উপধারায় ‘যথানিয়মে বিমা করবেন’ বলে যে উল্লেখ রয়েছে, তা লঙ্ঘন করলে কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। আইনের এ সুযোগ নিয়েই বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের বিমা না করিয়েই রাস্তায় নামানো হয়।
আবার আইনের ৯৮ নম্বর ধারায় শাস্তির বিধানের কথা বলা আছে। অর্থাৎ আইনেই বিভ্রান্তির সুযোগ রয়েছে। সে জন্য বিভ্রান্তি দূর করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর একটি পরিপত্র জারি করে। তাতে বলা হয়, আইনের ৬০(১), (২) ও (৩) উপধারা অনুযায়ী, তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকিবিমা বাধ্যতামূলক নয় এবং কেউ কোনো ধারা লঙ্ঘন করলে মোটরযান বা মোটরযানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) জানিয়েছে বিআরটিএ।
বর্তমান আইনে কী আছে
দেশের বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-তে যাত্রী বা মোটরযানের বিমা নিয়ে চারটি উপধারা আছে। এর মধ্যে একটি উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলে তার মালিকানাধীন যেকোনো মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট করা, তাদের জীবন ও সম্পদের বিমা করতে পারবে।
আরেকটি উপধারায় বলা হয়েছে, মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান তাদের অধীনে পরিচালিত মোটরযানের জন্য যথানিয়মে বিমা করবেন এবং মোটরযানের ক্ষতি বা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বিমার আওতাভুক্ত থাকবে এবং বিমাকারীর মাধ্যমে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী হবে।
এ-সংক্রান্ত তৃতীয় উপধারা বলছে, মোটরযান দুর্ঘটনায় পড়লে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা নষ্ট হলে সেটির জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে না। এ ছাড়া অন্য উপধারায় বলা হয়েছে, বিমার শর্ত, বিমার দায়দায়িত্বের সীমা, বিমার দেউলিয়াত্ব, বিমা দাবি পরিশোধ, বিরোধ নিষ্পত্তি, বিমা সনদের কার্যকারিতা ও তা হস্তান্তর এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।