দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ইফতারে বহুল ব্যবহৃত দুই ধরনের খেজুরের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। বাজারে খেজুরের দাম চড়া—বেশ কিছুদিন ধরে এমন অভিযোগ ওঠার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের খেজুরের দাম নির্ধারণ করে দেয়।
কিন্তু গতকাল বুধবার রাজধানীর বাজারে সরকারের এই নির্দেশনা মেনে চলার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বিক্রেতারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে খেজুর বিক্রি করলে তাঁদের লোকসান হবে।
খেজুরের দাম নির্ধারণের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে, খুচরা বাজারে অতিসাধারণ ও নিম্নমানের খেজুর প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং বহুল ব্যবহৃত জাইদি খেজুর ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে সরকার এক দফা খেজুরের শুল্ক-কর কমিয়েছিল। কিন্তু বাজারে শুল্ক হ্রাসের প্রভাব না থাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই ধরনের খেজুরের দাম নির্ধারণ করে দেয়।
গতকাল রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মান ভেদে প্রতি কেজি জাইদি খেজুর ২৫০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর অতি সাধারণ ও নিম্নমানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকার আশপাশে। বিক্রেতারা জানান, রোজা শুরু হওয়ার অন্তত সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বাজারে এই দুই ধরনের খেজুর মোটামুটি এমন দামে বিক্রি হচ্ছে।
খেজুর প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং বহুল ব্যবহৃত জাইদি খেজুর ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বাজারে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে তাঁরা যে খেজুর কিনেছেন, তার দাম বাড়তি ছিল। সরকার খুচরা বাজারের জন্য যে দাম বেঁধে দিয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাইকারি বাজার থেকে তার কাছাকাছি দামেই তাঁদের খেজুর কিনতে হয়েছে। ফলে সরকার নির্ধারিত দামে খেজুর বিক্রি করতে হলে তাঁরা লোকসানে পড়বেন।
ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানান, সরকার এমন এক সময় খেজুরের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, যখন রমজান শুরু হয়ে গেছে। তাতে বাজারে বেঁধে দেওয়া দামের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম বলে মনে করেন তাঁরা।
রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মান ভেদে প্রতি কেজি জাইদি খেজুর ২৫০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর অতি সাধারণ ও নিম্নমানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকার আশপাশে।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী ভুট্টো ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম কমানোর মতো পরিস্থিতিতে নেই। কেউ হয়তো বেশি পরিমাণে নিলে কিছুটা কম দামে দেওয়া সম্ভব।’ চাহিদা না কমা পর্যন্ত খেজুরের দাম কমার সম্ভাবনা দেখছেন না এই বিক্রেতা।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম শেখ মনে করেন, এভাবে দাম বেঁধে দেওয়া ঠিক হয়নি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দাম বেঁধে না দিয়ে সরকার বরং টিসিবির মাধ্যমে খেজুর আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিতে পারত।
খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম কমানোর মতো পরিস্থিতিতে নেই। কেউ হয়তো বেশি পরিমাণে নিলে কিছুটা কম দামে দেওয়া সম্ভব।কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী ভুট্টো ব্যাপারী
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেখা গেছে, শুল্ক–কর কমানোর পর গত এক মাসে (৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ মার্চ) ৩৮ হাজার ২০৫ টন খেজুর আমদানি করা হয়। মোট আমদানির ২৮ শতাংশই ছিল জাইদি খেজুর। তবে সবচেয়ে বেশি এসেছে খোলা খেজুর বা ৩০ কেজির বস্তায় আনা খেজুর। গত এক মাসে মোট আমদানি হওয়া খেজুরের ৫১ শতাংশই এসেছে বস্তাভর্তি হয়ে।
খেজুরের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে গত সোমবার জারি করা স্মারকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে আমদানি করা বিভিন্ন মানের খেজুরের আমদানি মূল্য, আরোপিত শুল্ক, কর ও আমদানিকারকদের অন্যান্য খরচ বিশ্লেষণ করে খেজুরের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের তুলনায় এবার সব ধরনের খেজুরের দাম কেজিতে অন্তত ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
বাজারে খেজুরের দাম কার্যকর করার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তদারকির মাধ্যমে বাজারে দাম কার্যকর করা কষ্টসাধ্য। তবে তিনি এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকালের বাজারদরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি সাধারণ মানের খেজুরের দাম পড়ছে ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকা। গত বছরের তুলনায় এই দাম সাড়ে ৪ শতাংশের মতো বেশি। রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের তুলনায় এবার সব ধরনের খেজুরের দাম কেজিতে অন্তত ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি না হওয়ার উদাহরণ আগেও ছিল। ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজের দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে সরকার এসব পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামে ওই পণ্যগুলো বিক্রি হতে দেখা যায়নি। এর বাইরে ভোজ্যতেল, চিনি ও রান্নার তরল গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বিভিন্ন সময়ে সরকার নির্ধারণ করে দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বাজারে কার্যকর হয়নি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে এভাবে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বাজার ঠিক করতে গেলে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে সরকার আমদানি করে চাহিদানুসারে জোগান নিশ্চিত করবে। তখন এমনও দেখা যাবে যে ক্রেতারা সরকারের নির্ধারিত দরের চেয়েও কম দামে পণ্য কিনতে পারছেন।