ডায়াপারের বাজারে এখন দেশি কোম্পানির দাপট

নগরজীবনে অন্য অনেক পণ্যের সঙ্গে শিশু যত্নের পণ্য ডায়াপারের চাহিদাও বাড়ছে। শুধু বড় শহর নয়, শহরাঞ্চল, এমনকি গ্রামেও ডায়াপারের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ফলে দেশে বেবি ডায়াপারের বাজার হু হু করে বড় হচ্ছে। তার চেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, এই বাজারের সিংহভাগই এখন দেশি কোম্পানির দখলে। যদিও আট বছর আগে এই বাজারের বড় অংশই ছিল বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে।

করোনার আগেও বাংলাদেশে বেবি ডায়াপারের বাজারের ৪০-৪৫ শতাংশ বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে ছিল। এখন তা কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তার মানে বর্তমানে বেবি ডায়াপারের প্রায় ৯০ শতাংশ বাজার দেশি কোম্পানির হাতে। আমদানিনির্ভরতা কমায় বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে। যদিও কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে ২৫-৩০ শতাংশ হারে ডায়াপারের বাজার বড় হচ্ছে। ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগও আসছে এ খাতে।

ওষুধ খাতের পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বিনিয়োগ করায় ডায়াপারের বাজারে দেশি ব্র্যান্ডের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০টি। সিলিকন করপোরেশনের চু চু ডায়াপার, এবি গ্রুপের থাই ডায়াপার, এসিআইয়ের স্যাভলন টুইংকেল, ইনসেপ্‌টার নিওকেয়ার, স্কয়ারের সুপারমম, বসুন্ধরার বেবি ডায়াপার, মেঘনা গ্রুপের হ্যাপি ন্যাপি, এসএমসির স্মাইল, প্রাণের কিডস্টার, আকিজের মাম মাম, ইউনিম্যাক্স ইন্ডাস্ট্রিজের অ্যাভোনি ইত্যাদি দেশি ব্র্যান্ড রয়েছে এই বাজারে। একটি ওষুধ কোম্পানি নতুন করে ডায়াপারের বাজারে আসার পরিকল্পনা করছে।

একাধিক দেশি কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে দুই রকমের ডায়াপার পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছে প্যান্ট ও বেল্ট ডায়াপার। তবে এই বাজারের সিংহভাগ প্যান্ট ডায়াপারের দখলে। শীত মৌসুমে ডায়াপারের ব্যবসা গ্রীষ্মকালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়। সব মিলিয়ে মাসে ১৬০-১৮০ কোটি টাকার ডায়াপার বিক্রি হয়। তাতে পণ্যটির বাজারের বার্ষিক আকার দাঁড়ায় ১ হাজার ৯২০ কোটি থেকে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার।

জার্মানভিত্তিক পরিসংখ্যানবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বে বেবি ডায়াপারের বাজার ৫৬ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের। চীন এই বাজারের ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ দখলে রেখেছে। গড়ে বিশ্বে প্রতিটি শিশু ১ দশমিক ১ কেজি ডায়াপার ব্যবহার করছে। যদিও বাংলাদেশের শিশুদের ক্ষেত্রে এই গড় শূন্য দশমিক ৭ কেজি।

দেশি কোম্পানি বাজারের শীর্ষে

করোনার আগেও দেশে ডায়াপারের বাজারে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের হিস্যা প্রায় কাছাকাছি ছিল। মহামারিতে বিধিনিষেধের কারণে আমদানি কম হওয়ায় দেশি ব্র্যান্ডের ব্যবসা তখন বেড়ে যায়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলারের দাম বাড়তে থাকলে বিদেশি ব্র্যান্ডের ডায়াপারের দামও বাড়তে থাকে। এ সময়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের ডায়াপারের দাম অনেকেরই হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। সেই সুযোগে দেশি ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে। যদিও কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়েছে। তাই দেশি ব্র্যান্ডগুলোও ডায়াপারের দাম কিছুটা বাড়ায়।

একাধিক দেশি কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, একসময় দেশে শুধু হাগিজ, মামিপোকোর মতো বিদেশি ব্র্যান্ডের ডায়াপার পাওয়া যেত। পুরান ঢাকার সিলিকন করপোরেশন প্রথম চু চু ডায়াপার বাজারে নিয়ে আসে। তারপর থাই, বসুন্ধরা, এসিআই; একের পর এক দেশি কোম্পানি এই পণ্য তৈরিতে বিনিয়োগ করতে থাকে। বেশির ভাগ কোম্পানি বাজারে এসেছে গত এক দশকে। বর্তমানে অভিজাত দোকানে হাতে গোনা কয়েকটি বিদেশি ব্র্যান্ডের ডায়াপারের দেখা মিললেও দেশি পণ্যই বেশি।

ডায়াপারের বাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর একটি এসিআইয়ের স্যাভলন টুইংকেল ব্র্যান্ড। এসিআই টয়লেট্রিজের প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা (সিবিও) কামরুল হাসান বলেন, অনেকগুলো দেশি কোম্পানি আসায় বাজারে ডায়াপারের দাম কমেছে। ২০২২ সালে যখন ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেল, তখন সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করা শুরু করল। তারই অংশ হিসেবে আমদানির ঋণপত্র খুলতে শতভাগ মার্জিন বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে আমদানি করা ডায়াপারের দাম বেড়ে যায়। সেই সুযোগে দেশি কোম্পানিগুলোর বাজার হিস্যা বাড়ে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে কামরুল হাসান বলেন, গত কয়েক বছরে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে পণ্যের গুণগত মানেও বেশ উন্নতি করেছে দেশি কয়েকটি কোম্পানি। ফলে যাঁরা বিদেশি ব্র্যান্ড থেকে দেশি ব্র্যান্ডে এসেছিলেন, তাঁরা আর বিদেশি ব্র্যান্ডে ফিরে যাননি। এভাবেই দেশি কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে এই বাজারে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে।

সম্ভাবনা রয়েছে, বিনিয়োগ বাড়ছে

বছর দুয়েক আগে ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের এক প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, বিশ্বে প্রতি চার মিনিটে এক হাজার শিশু জন্ম নেয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে জন্ম নেয় ২১টি শিশু। অর্থাৎ দিনে ৭ হাজার ৫৬০ শিশুর জন্ম হয়। মাসে ২ লাখ ২৬ হাজার ৮০০টি।

ডায়াপারের দুই কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেক দেশে ৭০-৮০ শতাংশ শিশু ডায়াপার ব্যবহার করে। বাংলাদেশে এ হার এখনো কম, ১০-১২ শতাংশের কাছাকাছি। সেই হিসাবে ভবিষ্যতে বাজারটি আরও বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, দেশের মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে জীবনযাত্রারও পরিবর্তন হচ্ছে। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।

ব্যবসা বৃদ্ধির পেছনে আরও কয়েকটি কারণের কথা জানালেন স্কয়ার টয়লেট্রিজের বিপণন বিভাগের প্রধান জেসমিন জামান। তিনি বলেন, এখনকার বাচ্চারা আগের চেয়ে কম বয়সে স্কুলে যাচ্ছে। আগে বাসার বাইরে গেলে ডায়াপার ব্যবহার করা হতো। আর এখন জন্মের পর থেকেই বাচ্চাকে ডায়াপার পরানো হয়। যারা ডায়াপার ব্যবহার করছে, তাদের দিনে তিন-চারটি ডায়াপার লাগে। ফলে চাহিদা বাড়ছে।

স্কয়ারের সুপারমম মূলত বেল্ট ডায়াপার উৎপাদন করে থাকে। বাজারে প্যান্ট ডায়াপারের চাহিদাই বেশি। ফলে তাঁরা প্যান্ট ডায়াপারে বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখছেন বলে জানালেন জেসমিন জামান।

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সাত বছর আগে কিডস্টার ব্র্যান্ড নামে ডায়াপার বিক্রি শুরু করে। প্রথম থেকে তারা বেল্ট ডায়াপার তৈরি করলেও আগামী বছরের শুরু থেকে প্যান্ট ডায়াপার নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে।

গ্রুপটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্স পারসোনাল কেয়ারের জেনারেল ম্যানেজার অরুণাংশু ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে মাসে ১৫-২০ লাখ ডায়াপারের ব্যবসা করছি। জানুয়ারিতে আমরা প্যান্ট ডায়াপার উৎপাদন শুরু করব। সেটি হলে আমাদের মাসে উৎপাদন ৬০-৭০ লাখে পৌঁছাবে।’

ডায়াপারের বাজারে নিজেদের হিস্যা বাড়াতে কারখানা সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করছে এসিআই। বর্তমানে তারা মাসে ১ কোটি ৬০ লাখ ডায়াপার উৎপাদন করে। শিগগিরই তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে সাড়ে তিন কোটিতে পৌঁছাবে, এমন তথ্য দিলেন এসিআইয়ের কর্মকর্তারা।

দাম এখনো বেশি কেন

এক ডজনের বেশি দেশি ব্র্যান্ড ডায়াপারের ব্যবসায় এলেও বাজারে ডায়াপারের দাম এখনো বেশি। ব্র্যান্ড ও শিশুর বয়সভেদে একেকটি ডায়াপারের দাম ১৬ থেকে ২৩ টাকা। উচ্চ মূল্যের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে বাড়তি শুল্ককে দায়ী করছে দেশি কোম্পানিগুলো।

ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালসের হাইজিং ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ডিপার্টমেন্ট) রাশেদুল ইমাম বলেন, আগে ডায়াপারের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য নিয়ে ক্রেতাদের বিশ্বাস ও আস্থায় ঘাটতি ছিল। এখন দেশি কোম্পানিগুলো মানসম্মত ডায়াপার তৈরি করে ক্রেতাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। ফলে দেশি কোম্পানিগুলোর বাজার হিস্যা বেড়েছে। দেশি উৎপাদন না থাকলে দু-তিন গুণ বেশি দামে আমদানি পণ্য কিনতে হতো।

রাশেদুল ইমাম আরও বলেন, ডায়াপারের সব কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। আমদানি শুল্কের কারণে দাম বেড়ে যায়। শুল্ক কমানো হলে দাম কিছুটা হলেও কমবে। বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বিএসটিআইয়ের লোগো-সংবলিত ডায়াপার কেনাবেচায় সবাই সচেতন হলে দেশীয় পণ্যের বাজার আরও বড় হবে।