কোভিড-১৯–এর ধাক্কা সামলিয়ে ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে পুরোদমে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এ রকম প্রেক্ষাপটে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের আমদানি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) লেখা এক চিঠিতে আমদানি বৃদ্ধিকে ‘নাটকীয়’ বলে উল্লেখ করেছে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়।
তবে অপরিণামদর্শী ও ক্রমবর্ধমান আমদানির কারণে যে বিপুল পরিমাণে মার্কিন ডলার ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল, তা নজরে রাখেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির। ওই অর্থবছরের ১১ মাসে ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতেই বাড়তি ডলার গুনতে হয়েছে ৭৬০ কোটি ডলার। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ এবং চলতি হিসাবেও ঘাটতি দেখা দেয় ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলার।
এসব কথা জানিয়েই ২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফকে চিঠি পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘এখন সময় খারাপ (ক্রিটিক্যাল টাইম) যাচ্ছে এবং জরুরি ভিত্তিতে লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বাজেট-সহায়তা বাবদ অর্থের দরকার।’
মোটাদাগে এটাই ছিল আইএমএফ থেকে ঋণ চাওয়ার পটভূমি। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি পঞ্জিকা বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য মোট ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ, যা সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে দেওয়ার কথা। বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ), এ তিনটি আলাদা ভাগে আসবে ঋণ। তবে আইএমএফ ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে ধাপে ধাপে তাদের ৩৮টি শর্ত পূরণের অঙ্গীকারের বিনিময়ে।
আইএমএফের ঋণ ও এর বিপরীতে দেওয়া শর্ত পূরণসহ আর্থিক খাত সংস্কারের প্রতিশ্রুতির জন্য নিঃসন্দেহে ২০২৩ সালটা আলোচিত বছর। কিন্তু কিছু আইন প্রণয়ন ও নীতিপদক্ষেপ নেওয়া হলেও বড় সংস্কারের দিকে সরকার যেতে পারেনি।—আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই।
দুই দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রথম কিস্তিতে পায় ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এরপর ১২ ডিসেম্বর এসে দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড় হয়। তবে বছরজুড়েই বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে যাওয়া ও আইএমএফের শর্ত পূরণ না হওয়ায় দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া না–পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল।
আইএমএফের ঋণ অনুমোদনে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে ৩৮টি শর্ত দেয়, তার বেশ কিছু ছিল আইন প্রণয়নবিষয়ক।
যেসব সংস্কারের ব্যাপারে আইএমএফ ও বাংলাদেশ একমত হয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রাজস্ব ও মুদ্রা বিনিময়ের হারসহ আর্থিক খাতের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সংস্কার এবং সামষ্টিক কাঠামো সংস্কার। আইএমএফের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে ঋণ ও আমানতের সুদহারে ৯ ও ৬ শতাংশ সুদহার বজায় রাখা থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বদলে সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করা হয় ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ (স্মার্ট) পদ্ধতি। এ বছরের জুলাই থেকেই তা কার্যকর করা হয়। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার বিবেচনা করে প্রতি মাসে একটি দর নির্ধারণ করে। এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যুক্ত করতে পারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
বছর শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায়ের শর্ত ছিল। এ নিয়ে আইএমএফ বলেছিল, বাড়তি অর্থ পাওয়া গেলে সামাজিক নিরাপত্তাসহ অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোতে বাংলাদেশ আরও বেশি খরচ করতে পারবে। এ লক্ষ্যমাত্রা পরে কমিয়ে দেয় আইএমএফ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ডিসেম্বরের মধ্যেই কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গড়ে তোলার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এটি অবশ্য পূরণ করে বাংলাদেশ। ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেওয়ার বলা হয়। এটিও পূরণ হয়ে যায়। কারণ, সঞ্চয়পত্রে এমনিতেই বিনিয়োগ কম হচ্ছে; বরং মানুষ আগের সঞ্চয়পত্র ভাঙাচ্ছে বেশি।
পেট্রোলিয়াম-জাতীয় পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয়ের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তা পূরণ হয়নি।
আইএমএফ বলেছিল, তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ীই ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টস ও ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল’ (বিপিএম৬) পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুতের হিসাব করতে হবে। প্রদর্শন করতে হবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব। এটি অবশ্য চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ থাকলেও প্রকৃত অর্থে তা হয়নি।
আইএমএফের শর্ত মেনে ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতাও পূরণ করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার শর্ত পূরণ হয়নি এখনো। ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন এবং আর্থিক কোম্পানি আইন পাসের শর্ত পূরণ হয়েছে।
বড় শর্তের মধ্যে বাংলাদেশ যা পারেনি, তা হচ্ছে রিজার্ভ সংরক্ষণ। বছরের শুরুতে ডিসেম্বরের জন্য রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল ২ হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে জুনের জন্য লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ২ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার। আইএমএফের চলতি মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই সময় নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারের মতো। গত অক্টোবরে নিট রিজার্ভ আরও কমে হয় ১ হাজার ৫৯০ কোটি ডলার। তখন মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি।
আইএমএফের সদস্যদেশগুলো ২০১২ সাল থেকে বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। বাংলাদেশ তা করছিল না। আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ গণনায় গত জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক এই মানদণ্ড অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের সময় আইএমএফ জানায়, বাংলাদেশকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার ‘নিট রিজার্ভ’ ১ হাজার ৭৭৮ কোটি (১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে হবে। সেই হিসাবে ঋণদাতা সংস্থাটি বাংলাদেশের জন্য লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে কমিয়ে ৯০০ কোটি ডলারের মতো কম ধরেছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার আগে আইএমএফকে জানানো হয়, আগামী সংসদ নির্বাচনের পর শুধু রিজার্ভ নয়, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জনের শর্তও পূরণ করা সম্ভব হবে।
জানতে চাইলে আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ ও এর বিপরীতে দেওয়া শর্ত পূরণসহ আর্থিক খাত সংস্কারের প্রতিশ্রুতির জন্য নিঃসন্দেহে ২০২৩ সালটা আলোচিত বছর। কিন্তু কিছু আইন প্রণয়ন ও নীতিপদক্ষেপ নেওয়া হলেও বড় সংস্কারের দিকে সরকার যেতে পারেনি। আইএমএফও যথেষ্ট নমনীয় ছিল। সে কারণেই শক্ত কোনো শর্ত দেয়নি, যা দিয়েছে তা–ও শিথিল করেছে কিছুটা। আগামী বছর আইএমএফ নমনীয় থাকবে বলে আর মনে হয় না।’
এ বছরই বা আইএমএফ নমনীয় ছিল কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথমবার বড় কর্মসূচি নেওয়াটা হয়তো অন্যতম কারণ। আর ভেতরে–ভেতরে এখানকার অবস্থা যে এতটা খারাপ—আমার ধারণা, আইএমএফও তা বুঝতে পারেনি।’