জাতীয় সংসদে দেশের বাজেট পেশ করার পরদিন একটি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। বাজেট নিয়ে যেসব আলোচনা-সমালোচনা বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক কিংবা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে কোনো না কোনোভাবে উত্থাপন করা হয়, সেগুলোর একটি জুতসই জবাব দেওয়ার চেষ্টা থাকে অর্থমন্ত্রীর দিক থেকে। ফলে বাজেটের পরের দিনের এ অনুষ্ঠান বাজেট-বিষয়ক কর্মকাণ্ডের অনেকটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেট নিয়ে আয়োজন করা আজকের সাংবাদ সম্মেলনে বড় রকমের বিশৃঙ্খলা লক্ষ করা গেছে। অনুষ্ঠানজুড়ে অব্যবস্থাপনার ছাপ ছিল স্পষ্ট। অনেক সাংবাদিক প্রশ্ন করতে পারেননি। আবার মন্ত্রী ও আমলারা যেসব জবাব দিয়েছেন, তা-ও ভালোমতো শুনতে পারেননি সাংবাদিকেরা। এ কারণে সংবাদ সম্মেলন শুরুর পর মাঝে প্রায় ২০ মিনিট বন্ধও ছিল।
গতকাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রীতি অনুযায়ী আজ বাজেটোত্তর সাংবাদ সম্মেলন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ছিল এর আয়োজন। বেলা তিনটায় শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন, চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ডানে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান। আর অর্থমন্ত্রীর বাঁয়ে বসে ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক-বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও পরিকল্পনা সচিব সত্যজিৎ কর্মকার।
সংবাদ সম্মেলন শুরুর পরই সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করতে গিয়ে সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে সমস্যায় পড়েন। এ সময় অর্থমন্ত্রীকেও বলতে শোনা যায়, ‘ভালো পরিবেশ দেওয়ার জন্য এখানে আনা হলো। এরপরও কেন সমস্যা হচ্ছে, বুঝতেছি না।’ এ সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনের কাজ আবার শুরু হলে শব্দ শুনতে না পারার অভিযোগ করতে থাকেন সাংবাদিকেরা। মন্ত্রীদের পক্ষ থেকেও বক্তব্য আসে, তাঁরাও শুনতে পাচ্ছেন না। এ সময় কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনেও মাঝে এমন সমস্যা হয়েছিল। কেন এমনটা হচ্ছে।
এরপর প্রায় ২০ মিনিটের জন্য সংবাদ সম্মেলন বন্ধ থাকে। এ সময় চিত্র ধারণ করছিলেন এমন বেশির ভাগ সাংবাদিককে মঞ্চের সামনে ভিড় করতে দেখা যায়। ফলে আমন্ত্রিত অতিথি ও সাংবাদিকদের দেখতে সমস্যা হয়। পরে শব্দব্যবস্থা ঠিকঠাক করে আবারও শুরু হয় সংবাদ সম্মেলনের কাজ। তবে আগ্রহী সব সাংবাদিক প্রশ্ন করতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন, তখনো কেউ কেউ প্রশ্ন করার চেষ্টা করছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেওয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি টেলিভিশনের সাংবাদিক প্রথম আলাকে বলেন, অনুষ্ঠানে যেসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হলো, শব্দের সমস্যার কারণে তা ভালোমতো ধারণ করা যায়নি। ফলে যতটুকু ভালো শব্দ পাওয়া গেছে, তা দিয়েই সংবাদ প্রচার করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী কিছু প্রশ্নের জবাব দেন। জ্বালানি খাত ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। বাজেটঘাটতি অর্থায়ন, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশির ভাগ প্রশ্নের জবাব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। করসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জবাব দেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। কৃষিমন্ত্রী কৃষিসংক্রান্ত ও অর্থমন্ত্রীর পক্ষে অনেক প্রশ্নের জবাব দেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
দুই দশক ধরে অর্থনীতি বিষয়ে লেখালেখি করেন এমন এক সাংবাদিক প্রথম আলোকে বলেন, বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন একজন সাংবাদিকের কাছে বাজেটবিষয়ক রিপোর্টিংয়ের অন্যতম দিক। বাজেটে যেসব বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকে, এর মাধ্যমে সেসব বিষয়ে ব্যাখ্যা পাওয়ার সুযোগ থাকে। এখন একাধিক মন্ত্রীর পাশাপাশি আমলাদের রাখা হয়। তবে এবার প্রশ্ন করার সুযোগ কম ছিল বলেই মনে হয়েছে। অনেক প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি।
সংবাদ সম্মেলনের অব্যবস্থাপনা বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব ফেরদৌস আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর কোনটি ? তিনি জানান, অর্থবিভাগ এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেছে এবং এ ব্যাপারে দায়িত্বে ছিল অর্থবিভাগের প্রশাসন অনুবিভাগ।
প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মানজারুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের শব্দব্যবস্থায় টেকনিক্যাল সমস্যা ছিল। বিষয়টি মাত্র পাঁচ মিনিটের ধৈর্য ধরার মতো বিষয় ছিল। এখানে মাঝেমধ্যেই এমন সমস্যা হয়। কেন সমস্যা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা খোঁজ নেব।’