শিল্প খাত

ঋণপত্র অর্ধেকে নেমেছে, কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি

শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩০ শতাংশ। ফলে শিল্প স্থাপনে নতুন প্রকল্প, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের উদ্যোগও কমে গেছে।

ডলার-সংকট, ডলারের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি এবং বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তার কারণে শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। একই কারণে শিল্প স্থাপনে নতুন প্রকল্প, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের উদ্যোগও কমে গেছে। ফলে গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৪ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩০ শতাংশ।

অন্যদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ভাটা এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাবে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে হয়েছে ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

এদিকে গত এপ্রিলে প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি রপ্তানি আয়েও বড় ধাক্কা লেগেছে। ডলার-সংকটের মধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান দুটি উৎস থেকেই দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে।

২০২৩ সালে রপ্তানি কমে যাবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে না, বরং কারখানা বন্ধের ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। গত সপ্তাহেও তিনটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করি ২০২৪ সালে আবার খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
মোহাম্মদ হাতেম, নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ

সাধারণত ঈদের মাসে প্রবাসী আয় অন্য সময়ের তুলনায় বেশি আসে। কিন্তু এবার ঈদের মাস এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬৮ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ কম। অন্যদিকে এপ্রিলে পণ্য রপ্তানি কমে হয় ৩৯৬ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। ফলে ডলার-সংকট কাটেনি; বরং ধীরে ধীরে বাড়ছে ডলারের দাম।

কমেছে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্র আমদানি

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয় ২১৪ কোটি ডলারের। গত বছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৪৬৬ কোটি ডলারের। ফলে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। একই সময়ে ঋণপত্র খোলার পাশাপাশি ঋণপত্র নিষ্পত্তিও কমেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এ সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার কমেছে ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমান অস্থির সময়ে কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করার সাহস দেখাচ্ছে না। তাঁদের কথায়, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে বর্তমানে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার ক্রয়াদেশও ভালো নেই।

মূলধনি যন্ত্রের পাশাপাশি শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে এই সময়ে। গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৫৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২২২ কোটি ডলার। অর্থাৎ কাঁচামাল আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ। একইভাবে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা সম্প্রসারণ নেই বললেই চলে। কারণ, গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে গেছে। উৎপাদনের যে সক্ষমতা আছে, তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এর ফলে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল দুটোরই আমদানি কমে গেছে।

এর ফলাফল কী হতে পারে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘২০২৩ সালে রপ্তানি কমে যাবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে না, বরং কারখানা বন্ধের ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। গত সপ্তাহেও তিনটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করি ২০২৪ সালে আবার খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’

কমল বেসরকারি খাতের ঋণও

এদিকে আমদানি কমায় ও নতুন শিল্পঋণের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বেসরকারি খাতে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন নতুন করে কোনো প্রকল্প যেমন তাঁরা নিচ্ছেন না, তেমনি আবার শিল্পের নিয়মিত সংস্কার ও সম্প্রসারণও কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে হয়েছে ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, জানুয়ারিতে যা ছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যমানের ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের এলসি খোলা হলে তা আটকেও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ডলার-স্বল্পতার কারণে অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা বন্ধ রেখেছে বা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণ কমেছে।

ব্যাংকাররা আরও বলছেন, ব্যাংকেও টাকার টানাটানি রয়েছে। ফলে বেছে বেছে ভালো ব্যবসায়ী ছাড়া অন্যদের ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে সব ব্যাংকই এখন এসএমই ও রিটেইল ঋণের দিকে ঝুঁকছে।

এদিকে রিটেইল ঋণে ব্যাংকঋণের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই তুলনায় শিল্পঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ।

জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় ও অস্থিরতার কারণে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ কমছে। তিনি মনে করেন, এতে অর্থনীতির গতি কমে যেতে পারে। শিল্প খাতে ব্যাংকের যে ঋণ রয়েছে, তা আদায়ের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।