একসময় খেজুরের রস ও গুড়ের মতো পণ্যের বাজার ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। এখন শহরের মানুষের কাছেও এসব পণ্যের কদর বাড়ছে।
দেশের বাজারে চিনির বিকল্প পণ্য হিসেবে গুড়ের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে শীতকালে খেজুরের রসের মতো গুড়েরও চাহিদা বেশ বৃদ্ধি পায়। একসময় খেজুরের রস ও গুড়ের বাজার ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। এখন অনেকে চিনির বিকল্প হিসেবে গুড় খেয়ে থাকেন। এতে কয়েক বছর ধরে শহরে গুড়ের চাহিদা বেড়েছে।
দেশে গুড় উৎপাদন যে খুব বেশি, তা বলা যাবে না। যেহেতু উৎপাদন সীমিত, সেহেতু একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ভেজাল গুড় তৈরি করেন। এ নিয়ে জোরালো অভিযোগ রয়েছে।
পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীতকালে শহরে খেজুরের গুড়ের বেশ চাহিদা থাকে। বাসাবাড়িতে তো বটেই, পাড়ামহল্লা ও রাস্তার ধারে বসা পিঠার দোকানেও খেজুরের গুড়ের ব্যবহার বেড়েছে। এ ছাড়া শহরের কোনো কোনো এলাকায় কিছু চায়ের দোকানে চিনিমিশ্রিত চায়ের পাশাপাশি গুড়ের চা-ও এখন সমাদৃত হচ্ছে। চায়ে অবশ্য আখের চেয়ে খেজুরের গুড়ের ব্যবহার একটু বেশি হয়।
কারওয়ান বাজারের মেসার্স বাসার ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছরে গুড়ের চাহিদা বেশ বেড়েছে। এমন কিছু ক্রেতা আছেন, যাঁরা সারা বছরই কমবেশি গুড় কেনেন। শীতের সময় চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। পিঠা বিক্রেতা থেকে শুরু করে সাধারণ ক্রেতাদের অধিকাংশই শীতকালে খেজুরের গুড় বেশি খোঁজেন। আখের গুড় বছরজুড়েই হয়ে থাকে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইট অনুসারে, দেশে প্রতিবছর সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টন গুড় উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে খেজুর ও তালের রস থেকে উৎপাদিত গুড়ের পরিমাণ ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টন। এর বড় অংশই খেজুরের গুড়। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, দেশে গুড়ের বাজার আরও বড়। অভিযোগ আছে, একধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্রমবর্ধমান চাহিদার সুযোগ নিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করেন।
খেজুরের গুড়ের চাহিদা আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে এখন ভেজালমুক্ত খেজুরের গুড় পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অধিকাংশ গুড়েই ভেজাল হিসেবে চিনি মেশানো থাকে।পিন্টু সাহা, খেজুরের গুড় বিক্রেতা, ফরিদপুর
ফরিদপুর শহরের খেজুরের গুড় বিক্রেতা পিন্টু সাহার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, খেজুরের গুড়ের চাহিদা আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে এখন ভেজালমুক্ত খেজুরের গুড় পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অধিকাংশ গুড়েই ভেজাল হিসেবে চিনি মেশানো থাকে। চিনির মাত্রা বিবেচনায় খেজুর গুড়ের দাম প্রতি কেজি ১৬০ থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
নাটোরের গুরুদাসপুর এলাকার গাছিদের দাবি, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চিনিসহ নানা রাসায়নিক উপকরণ মিশিয়ে খেজুর গুড় তৈরি করেন। এতে খেজুরের গুড়ের প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যায় না। খেজুরের গুড়ের প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে গাছিদের কাছ থেকেই সরাসরি গুড় সংগ্রহের পরামর্শ দেন তাঁরা।
গুরুদাসপুরেরই মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন, রাহেন গাইনসহ কয়েকজন গাছি প্রথম আলোকে বলেন, দিন দিন খেজুরগাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জ্বালানিসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়েছে। এ কারণে গুড়ের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে বাজারে চাহিদা বাড়ছে, গাছিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। তাই গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি সহায়তা দাবি করেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খেজুরের গুড়ের মধ্যে নানা রকমফের আছে। যেমন ঝোলা গুড়, দানা গুড়, পাটালি (জমাট বাঁধা), নলেন গুড়, হাজারি গুড়। গুড়ের পাশাপাশি খেজুরের রসও বেশ সুস্বাদু। এটি দিয়ে শীতকালে পায়েস খেতে পছন্দ করেন অনেকে। আর খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন পিঠা, জিলাপি ইত্যাদির স্বাদ অসাধারণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চুয়াডাঙ্গা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে এই জেলায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৬০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড় উৎপাদিত হচ্ছে। চলতি মৌসুমে জেলায় গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৬৪ টন। বর্তমানে প্রতি টন গুড়ের দাম ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে। সেই হিসাবে এই মৌসুমে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার খেজুরের গুড় বিক্রি হবে চুয়াডাঙ্গায়।
চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও যেসব জেলায় খেজুরের গুড়ের বাজার বড়, তার মধ্যে অন্যতম যশোর। এ ছাড়া ফরিদপুর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলায়ও খেজুর গুড়ের উৎপাদন ভালো। দেশের অন্য সব জেলায়ও খেজুরের রস ও গুড় পাওয়া যায়, যদিও তা পরিমাণে কম।
ঢাকার বড় বাজারগুলো থেকে শুরু করে ছোট ছোট দোকান ও অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন বিক্রেতার কাছে গুড় পাওয়া যায়। তবে নানা পদের গুড়ের মধ্যে দেখেশুনে কিনতে চাইলে কারওয়ান বাজার বা মৌলভীবাজারের মতো বড় বাজারে যাওয়াই ভালো। এসব বাজার থেকে খুচরায় খেজুরের গুড় কিনতে হলে প্রতি কেজির দাম পড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তবে এই দামে খেজুরের গুড় কিনলে আপনাকে মানের সঙ্গে আপস করতে হবে।
বিক্রেতাদের সঙ্গে একটু খাতির জমিয়ে একেবারে ভেজালমুক্ত খেজুরের গুড় চাইলে এর জন্য কেজিতে অন্তত ৫০০ টাকা দাম দিতে হবে। কোনো কোনো বিক্রেতা এক কেজি খেজুরের গুড়ের দাম ৬০০ টাকাও হাঁকেন। অন্যদিকে বাজারে মানভেদে আখের গুড়ের কেজি এখন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
কয়েক বছর ধরে খেজুরের রস থেকে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। গত মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আবারও নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। কীভাবে এ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়, এ নিয়ে অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ গত মাসে প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালে খেজুরগাছে রস সংগ্রহের যে হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়, রাতে তাতে বাদুড় মুখ দেয়। এতে বাদুড়ের লালা রসে মিশে যায়। অনেক সময় বাদুড়ের মলমূত্রও রসকে দূষিত করে। এই মলমূত্র বা লালা থেকেই ছড়ায় নিপাহ ভাইরাস।
অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, শীতে খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না। তবে রস জ্বাল দিলে এর মধ্যে থাকা জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। তাই জ্বাল দিয়ে, গুড় বা চিনি তৈরি করে খাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, স্ফুটনাঙ্কের ওপর তাপমাত্রায় জ্বাল দিতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডা করে খেতে হবে। খেজুরের কাঁচা রসে ভেজানো পিঠাপুলি খাওয়া যাবে না।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ফরিদপুর; প্রতিনিধি, (চুয়াডাঙ্গা ও গুরুদাসপুর), নাটোর]