এশিয়ার অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে পোশাকশিল্পের বড় অবদান আছে। এই মহাদেশের দেশগুলো বিশ্ববাজারের জন্য টি-শার্ট ও ট্রাউজার উৎপাদন করে হাজার হাজার কোটি ডলার আয় করেছে। এই শিল্প যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে, বাংলাদেশের চেয়ে এত ভালো নজির আর হতে পারে না।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অস্থিরতার জন্য কিছু কাজ ভারতে চলে যাচ্ছে। যদিও এর পরিমাণ খুব উল্লেখযোগ্য নয় বলে ইকোনমিস্ট মনে করছে।
১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ। এরপর পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশটির তৈরি পোশাক খাতে এখন ৪০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করছে। দেশের জিডিপিতে এই খাতের অবদান ১০ শতাংশ। গত বছর বাংলাদেশ ৫৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। এ ক্ষেত্রে চীনের পরেই তার অবস্থান।
কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে অস্থিরতা চলছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন—এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তবে ওই সরকারের পতনের মাসাধিককাল পরেও অস্থিরতা থামেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বলীয়ান হয়ে পোশাক খাতের শ্রমিকসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী নতুন সরকারের কাছে দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। সেই সঙ্গে চলছে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট। চলতি বছর গ্যাস–সংকটের কারণে এমনিতেই শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ইকোনমিস্ট মনে করছে, সামগ্রিকভাবে চলতি বছর পোশাক রপ্তানি ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমবে।
এই পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশ সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে ভারতের কথা বলা হয়েছে। সুতা উৎপাদনে এই দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হলেও তৈরি পোশাক উৎপাদনে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। অর্থমূল্যের দিক থেকে ২০২৩ সালে ভারত বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ পোশাক রপ্তানি করেছে। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের তামিলনাড়ুর ত্রিপুর শহরভিত্তিক পোশাক উৎপাদনকারীরা ৫৪ মিলিয়ন বা ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের নতুন পোশাক উৎপাদনের কার্যাদেশ পেয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক খাতে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় এসব কাজ তাদের কাছে চলে এসেছে। পার্শ্ববর্তী এলাকার এক পোশাক উৎপাদনকারী গোষ্ঠী বলেছে, আগস্ট মাসে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড জারার কাছ থেকে তারা ১৫ শতাংশ বেশি কার্যাদেশ পেয়েছে।
ইকোনমিস্ট মনে করছে, পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রাধান্য গুরুতরভাবে খর্ব করা ভারতের পক্ষে কঠিন। বাংলাদেশের পোশাক খাত বিশ্লেষক মেহেদি মাহবুব ইকোনমিস্টকে বলেন, পোশাক খাতে এখন যে অস্থিরতা চলছে, তা সাময়িক। কারখানা খুলতে শুরু করেছে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা, প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশের বড় কিছু সুবিধা আছে। বাংলাদেশের শ্রম ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। এ ছাড়া ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ এখনো অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পায়, ভারত যা পায় না।
সর্বোপরি বাংলাদেশের পোশাক খাতের যে পরিস্থিতি, তাতে বড় বড় কার্যাদেশ সামলানোর সক্ষমতা তার আছে। মার্কিন ব্র্যান্ড গ্যাপের এক কর্মকর্তা ইকোনমিস্টকে বলেন, বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ক্রেতারা ‘সতর্কতার সঙ্গে আশাবাদী’।
এই খাতের আরেকজন বিশেষজ্ঞ ইকোনমিস্টকে বলেন, ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। ভারতের সরকার পুঁজিঘন শিল্পে (ইলেকট্রনিকস) যতটা মনোযোগ দিচ্ছে, শ্রমঘন খাতে ততটা দিচ্ছে না। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অর্থমূল্যে ভারতের পোশাক রপ্তানি যেখানে ১৫ শতাংশ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশের বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ভারতের পোশাক খাতের এই দুরবস্থার পেছনে সুরক্ষাবাদী নীতির সমালোচনা করা হয়েছে। ভারতে পোশাক ও বস্ত্র আমদানিতে গড় শুল্ক ২০১৭ সালের পর ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এমনকি স্থানীয় উৎপাদনকারীরা যে অন্তর্বর্তী পণ্য ব্যবহার করেন, সেগুলো আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে সে দেশের পোশাক উৎপাদনের খরচ বেড়েছে।
চীনে স্বল্পমূল্যের পোশাক উৎপাদনে যে ভাটা শুরু হয়েছে, সেটাই ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এখানেও ভারতকে বাংলাদেশের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, চীনের স্বল্পমূল্যে পোশাক উৎপাদন কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। সেই সঙ্গে কাজের মান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; সরবরাহ ব্যবস্থার ওপরের দিকে যেতে হলে মানের উন্নতি করতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই আগামী দুই দশকের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চায়। সেটা করতে হলে অর্থনীতিতে আরও বৈচিত্র্য আনতে হবে বলে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।