ছোটরা মার খেলেও বড় ব্র্যান্ডের ব্যবসা ভালো

মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের পাশে ফুটপাতে কাঠের চৌকির ওপর ছেলেদের জিনস প্যান্ট বিক্রি করেন মো. মোক্তার হোসেন। ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসার জন্য এবার সাত লাখ টাকার প্যান্ট কিনেছেন। একেকটি প্যান্ট তিনি বিক্রি করছেন ৪০০ থেকে ৮০০ টাকায়।

জানতে চাইলে গত রোববার বেলা ১১টার দিকে মোক্তার হোসেন বলেন, গত শনিবার, ২৬ রোজা পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ টাকার জিনস প্যান্ট বিক্রি করেছেন। গত বছরের চেয়ে ব্যবসা কম, নাকি বেশি—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় দুই লাখ টাকার মতো বিক্রি কম হয়েছে।

আমাদের দেশে ঈদকেন্দ্রিক বাজারে পোশাক ও জুতার ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ। এসব পণ্য বেচাকেনা কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি না হওয়া।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক,  সিপিডি

মোক্তার হোসেনের মতো মিরপুর-১০, মিরপুর-১ ও নিউমার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেটের কয়েকজন ফুটপাতের ব্যবসায়ী জানালেন, ক্রেতাদের আনাগোনা কমবেশি আছে, কিন্তু পোশাকের দাম এবার কিছুটা বেশি হওয়ায় পরিমাণে কম কিনছেন ক্রেতারা। ফলে গত বছরের তুলনায় বিক্রি কমে গেছে। ফুটপাতের পাশাপাশি ঢাকার অনেক বিপণিবিতান ও নন–ব্র্যান্ডের দোকানেও বিক্রি এবার গতবারের তুলনায় কম।

অবশ্য ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ভালো করছে নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো। তাদের বিক্রি গতবারের চেয়ে ১০ শতাংশ বা তার বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে দেশি পোশাক বিক্রির সঙ্গে জড়িত ফ্যাশন হাউসগুলোর বিক্রি গত বছরের কাছাকাছি বা কিছুটা কম হবে।

ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি কত হাজার কোটি টাকার, তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বড় এই উৎসবে শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, জামা, জুতা থেকে শুরু করে গাড়ির মতো বিলাসী পণ্যের ব্যবসা চাঙা হয়। ঈদের পর পয়লা বৈশাখেও দেশি পণ্যের ভালো ব্যবসা হয়। এবার ঈদের পরপরই পয়লা বৈশাখ হওয়ায় বাড়তি ব্যবসা হচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

ঈদের বেচাবিক্রি কম

গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড় দিয়ে নিউমার্কেট যাওয়ার পথে যানজটের মুখে পড়তে হয়। যানজট ঠেলে গাউছিয়া মার্কেটের সামনে গিয়ে দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক ক্রেতার ভিড়। ক্রেতারা পছন্দের পণ্য কিনতে ফুটপাতের পাশাপাশি মার্কেটের দোকানে ভিড় করেছেন।

গাউছিয়া মার্কেটের সামনের ফুটপাতে মেয়েদের হাতব্যাগ বিক্রি করেন ইয়াসিন খান। তিনি বলেন, ২০ রোজা পর্যন্ত বেচাকেনা কম ছিল; এরপর বিক্রি বাড়লেও আশানুরূপ নয়। গত বছরের তুলনায় দিনে ২০-৩০ হাজার টাকা কম বিক্রি হচ্ছে।

শুধু ফুটপাতের বিক্রেতা নন, মার্কেটের ভেতরে যাঁদের স্থায়ী দোকান আছে, তাঁদের অনেকের বিক্রিও প্রত্যাশামাফিক হচ্ছে না। গাউছিয়া মার্কেটে থ্রি–পিস বিক্রির দোকান প্যাটেলের ব্যবস্থাপক কবির হাসান বলেন, ‘গত ঈদে প্রায় দেড় হাজার থ্রি–পিস এনেছিলাম, এর মধ্যে ১ হাজার ২০০ বিক্রি হয়। এবার প্রথম দফায় এক হাজার থ্রি–পিস এনেছি; পরিকল্পনা ছিল, সেগুলো বিক্রি হলে আবার আনব। এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০০ বিক্রি করতে পেরেছি।’

ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা সালমা আলম। তিনি বলেন, ‘ঈদে পরিবার ও আত্মীয়দের জন্য কেনাকাটা করতে হয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই কেনাকাটা যতটুকু না করলে নয়, ততটুকু করছি।’

শেষ মুহূর্তে রাজধানীতে জমে উঠেছে ঈদের কেনাবেচা।

দেশি ব্র্যান্ডের হালচাল

দেশি পোশাকের জন্য সাদাকালো, ক্রে ক্র্যাফট, রঙ বাংলাদেশ, দেশাল, বিবিয়ানা, যাত্রা, নিপুণসহ কয়েকটি ফ্যাশন হাউস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ বলেন, রোজার শুরুতে বিক্রি খারাপ ছিল, শেষের দিকে বিক্রি বাড়লেও তা আশানুরুপ নয়। ফলে গতবারের মতো বিক্রি হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, কাঁচামালের দাম বেড়েছে কিন্তু পণ্যের দাম সেই হারে বাড়ানো যায়নি।

ঈদের বেচাকেনা সম্পর্কে একই ইঙ্গিত দিলেন ফ্যাশন হাউস অঞ্জনসের কর্ণধার শাহীন আহম্মেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা মোটামুটি হচ্ছে। তবে আশানুরূপ বলা যাবে না। এখন পর্যন্ত যে প্রবণতা, তাতে গত ঈদুল ফিতরের কাছাকাছি বা তার চেয়ে কিছু কম বিক্রি হবে এবার, যদিও বিপণিবিতানে ক্রেতাদের আনাগোনা আছে। বিক্রি কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে অনেকের, সব মিলিয়ে বিক্রি কমেছে।

বড় ব্র্যান্ডের ব্যবসা ভালো

দেশে পোশাকের বাজার বাড়ছে, চালু হচ্ছে নতুন নতুন ব্র্যান্ড। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আছে আড়ং, ইয়েলো, সেইলর, লা রিভ, সারা লাইফস্টাইল, টুয়েলভ, জেন্টল পার্ক, ক্যাটস আই, এক্সটাসি, ক্লাব হাউস ইত্যাদি।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক টিম গ্রুপের দেশি পোশাকের ব্র্যান্ড হচ্ছে টুয়েলভ। বর্তমানে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৪১। তাদের বিক্রি গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বাড়তি আর গতবার যতগুলো বিক্রয়কেন্দ্র ছিল, সেগুলো হিসাবে নিলে বাড়বে ১৬ শতাংশের মতো।

টুয়েলভের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছর রোজার প্রথম তিন সপ্তাহে ঢাকায় ভালো বিক্রি হয়েছে। শেষ সপ্তাহে বিক্রিতে শীর্ষে ছিল ঢাকার বাইরের জেলাগুলো। মূলত ঢাকার মানুষের গ্রামে চলে যাওয়া এবং প্রবাস থেকে পাঠানো অর্থ দেশে আসায় শেষ সময়ে জেলাপর্যায়ে বিক্রি বাড়ে।

পোশাকের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড সেইলর। এর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) রেজাউল কবীর বলেন, ব্যবসা ভালো হচ্ছে। তবে আরও ভালো হওয়া উচিত ছিল, শেষ পর্যন্ত ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। পোশাকের দাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, খরচ যেটুকু বেড়েছে, তার পুরোটা ক্রেতার ওপর না দিয়ে সহনীয় রাখা হয়েছে, পোশাকভেদে ১৫-২০ শতাংশ মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পোশাকের আরেক ব্র্যান্ড সারা লাইফস্টাইলের বর্তমানে বিক্রয়কেন্দ্র আছে ১৪টি। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন হয়েছে চারটি। এবার এখন পর্যন্ত তাদের বিক্রি বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। তবে গত ঈদুল ফিতর পর্যন্ত বিক্রয়কেন্দ্র ছিল ১০টি। সেসব বিক্রয়কেন্দ্রে ব্যবসা বেড়েছে ২০-২৫ শতাংশ।

এসব তথ্য দিয়ে সারা লাইফস্টাইলের মূল প্রতিষ্ঠান স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণে গত বছর মানুষের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। এবার অনিশ্চয়তা না থাকলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ চাপে আছেন, তা না হলে আরেকটু বেশি বিক্রি হতো। কাঁচামাল ও ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বাড়লেও কৌশলগত কারণে সারার পোশাকের দাম বাড়ানো হয়নি।

জুতার বিক্রি বেড়েছে

ঈদে পোশাকের পরই জুতার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দেশে জুতার বাজার ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি, এর মধ্যে ঈদুল ফিতরে বিক্রি হয় ২৫-৩০ শতাংশ। আর জুতার বাজারে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে অ্যাপেক্স ও বাটা।

সারা দেশে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ফ্র্যাঞ্চাইজি ও নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৪৯৪টি। তা ছাড়া ১ হাজার পাইকারি বিক্রেতার মাধ্যমে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার দোকানে বিক্রি হয় অ্যাপেক্সের জুতা।

অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) ফিরোজ মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবারের ঈদে আমাদের ব্যবসা ভালো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত গতবারের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি বিক্রি হয়েছে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপজেলা ও মফস্‌সল শহরেও বিক্রি খারাপ হচ্ছে না।

দেশের জুতার বাজারে আরেক শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড বাটার জুতাও গত বছরের তুলনায় বেশি বিক্রি হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাটা বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এ তথ্য দিয়ে বলেছেন, ২৯ রোজা হলে প্রবৃদ্ধি হবে এক অঙ্কের। আর রোজা ৩০টি হলে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হবে। বিক্রি বাড়াতে বাটা এই প্রথম ঈদে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে মূল্যছাড় দিয়েছে।

আজ রাজধানীর ফুটপাতের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে। তবে এবারের ঈদে ফুটপাতের ব্যবসা ভালো হচ্ছে না।

জুতার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, নন–ব্র্যান্ডের দোকানে বিক্রি কম। ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের আশপাশে মৃদুল সুজের তিনটি দোকান আছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. সানি আহমেদ জানান, ঈদের ব্যবসা করতে প্রায় এক কোটি টাকার জুতা কেনা হয়েছে। ২৬ রোজা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকার জুতা, যদিও গত রোজায় এমন সময়ে ৮০ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়েছিল।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পোশাকের দাম বেড়েছে। তবে মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। নিত্যপণ্যের দামও অনেক দিন থেকেই বাড়তি। ফলে ঈদ কেনাকাটায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের বাজেট সীমিত হয়েছে। তার প্রভাবে ফুটপাত, নন–ব্র্যান্ডসহ ছোটদের ব্যবসা কমেছে। অন্যদিকে উচ্চবিত্তের টাকাপয়সা নিয়ে টেনশন নেই। ফলে বড় ব্র্যান্ডের পণ্যের দাম বাড়লেও সমস্যা হয়নি।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ঈদকেন্দ্রিক বাজারে পোশাক ও জুতার ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ। এসব পণ্য বেচাকেনা কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি না হওয়া। এতে পণ্যগুলোর উৎপাদনে নিয়োজিত বিপুল মানুষের আয় কমে যায়; আয় কমে গেলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়।’