বাংলা নববর্ষে বাঙালি সাজে সাজবেন বৃষ্টি দে। তাই কাচের চুড়ি কিনছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনে থেকে। তখনই কথা হলো তাঁর সঙ্গে। রঙিন পোশাক, রঙিন সাজসজ্জা, সঙ্গে রঙিন চুড়ি—এসব ছাড়া বাঙালি সাজ অনেকটাই যেন অসম্পূর্ণ বৃষ্টির কাছে।
‘কাচের চুড়ি পরলে একটা রিনিঝিনি শব্দ হয়। অন্য কোনো চুড়িতে এত সুন্দর শব্দ হয় না। শব্দটা আমার ভালো লাগে। তাই কাচের চুড়ি বেশি পছন্দ করি,’ প্রথম আলোকে বলছিলেন এই চাকরিজীবী। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, অনেক রঙের কাচের চুড়ি পাওয়ার কারণে সহজেই যেকোনো শাড়ির সঙ্গে মানিয়ে যায়।
কাচের চুড়ির কেনাবেচা সারা বছর ধরেই চলে। তবে উৎসবের সময় এর বিক্রি বাড়ে অনেক গুণ। উৎসব আর কাচের চুড়ি যেন হাত ধরে চলে। এর আবেদন আর জনপ্রিয়তা চিরকালীন। বাঙালি নারীর ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাচের রেশমি চুড়ি। শাড়ি কিংবা সালোয়ার-কামিজ, উভয়ের সঙ্গেই মানিয়ে যায় এসব চুড়ি।
বিভিন্ন নকশার কাচের চুড়ি মেয়েরা কেনেন পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুড়ির ঢঙে বদল এসেছে। বাজারে এখন ফাইবার, মেটাল, সুতাসহ নানা ধরনের চুড়ি পাওয়া গেলেও কাচের চুড়ির কদর একটুও কমেনি। কাচের রেশমি চুড়ি একসময় বেশ পাতলা ছিল। তবে এখন বাজারে ভারী বিভিন্ন নকশার কাচের চুড়ি পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে রোমান সভ্যতায় চুড়িতে কাচের ব্যবহারের কথা জানা যায়।
জমজমাট চুড়ির বাজার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে রঙিন চুড়ির ডালা নিয়ে বসেন নাছিমা বেগম ও তাঁর স্বামী মো. মোবারক। প্রায় ১০ বছর ধরে তাঁরা চুড়ির ব্যবসা করছেন। নাছিমা বেগম জানান, ঈদ, বইমেলা, পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন, বিজয় দিবসসহ বিশেষ দিনগুলোয় বিক্রি বেশি হয়।
চারুকলা অনুষদের আশপাশের আরও কিছু এলাকায় বাহারি চুড়ির ডালা নিয়ে বসেন অনেকেই। নাসিমা বেগমের মতো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রতিদিন তাঁদের বিক্রির পরিমাণ দুই থেকে তিন হাজার টাকা। তবে বিশেষ দিনগুলোয় বিক্রি পাঁচ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। বেশি বিক্রি হয় শুক্রবারে।
খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সব সময়ই ১০ থেকে ১৫ রকম চুড়ির মজুত থাকে। তবে বেশি চাহিদা কাচের রেশমি চুড়ির। কাচের রেশমি চুড়ির একটি সেট অর্থাৎ এক ডজনের দাম রাখা হয় ৫০ থেকে ৮০ টাকা।
চুড়ির আরেকটি বড় বাজার হলো ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট। কথা হলো গাউছিয়া মার্কেটের চুড়ি ব্যবসায়ী মো. রবিনের সঙ্গে। তিনি জানান, সাধারণত বিয়ের মৌসুম অর্থাৎ ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাস চুড়ির ব্যবসা রমরমা থাকে। তখন বিক্রি বাড়ে। তবে সাধারণ সময়ে তাঁদের প্রতিদিন কমবেশি আট–নয় হাজার টাকার চুড়ি বিক্রি হয়।
চুড়ির পাইকারি বাজার অবশ্য ঢাকার চকবাজারে। এখান থেকেই চুড়ি ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্য সংগ্রহ করেন এবং বিক্রি করেন সারা দেশে। সেখানে গিয়ে জানা গেল, এক থেকে দেড় হাজার রকম চুড়ি পাওয়া যায় চকবাজারের দোকানগুলোয়। চুড়িগুলোর আবার রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। এর মধ্যে রয়েছে কাচের রেশমি চুড়ি, দুলহান চোড়া, ঝলক, পেখম, মাল্টি, জয়পুরী, কাচবালা, টিকটক, ইন্ডিয়ান ভেলভেট, ইন্ডিয়ান দাবা, ইন্ডিয়ান কেশ—এমন বাহারি নামের চুড়ি।
চকবাজারে একজন ক্রেতা সর্বনিম্ন ৫ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা পর্যন্ত দামে চুড়ি কিনতে পারেন। তবে চকের বিক্রেতারা সাধারণত খুচরা বিক্রি করেন না। এখানে চুড়ির ধরন ও ওপরের নকশা অনুসারে দাম নির্ধারণ করা হয়। যেমন কাচের রেশমি চুড়ির পাইকারি দাম ২৫-২৭ টাকা, বাচ্চাদের চুড়ির দাম ৫-১০ টাকা, আর বৌ চুড়ি পাওয়া যায় ৪০০ টাকায়।
চকবাজারের পাইকারি চুড়ি ব্যবসায়ী মো. রাকিব জানান, তাঁদের দোকানে প্রতিদিন কমবেশি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার চুড়ি বিক্রি হয়ে থাকে।
চুড়ির অর্থনীতি
স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশে ঠিক কী পরিমাণ চুড়ির উৎপাদন এবং বিক্রি হয়, সে সম্পর্কে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া গেল না। তবে চুড়ি বিক্রি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায় চকবাজারের ব্যবসায়ী মো. রাকিবের কথায়।
রাকিব জানান, চকবাজার শাহি মসজিদের বিপরীতে গোটা পনেরো চুড়ির দোকান রয়েছে। কম করে ধরলেও একটি দোকানে মাসে আনুমানিক ৯ লাখ টাকার চুড়ি বিক্রি হয়। সেই হিসাবে ১৫টি দোকানে মাসে বিক্রি হয় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার চুড়ি। আর বছরে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকা।
স্থানীয়ভাবে যেসব জায়গায় চুড়ির উৎপাদন হয়, তার একটি ঢাকার কামরাঙ্গীরচর। এখানে চুড়ি তৈরির কয়েকটি কারখানা রয়েছে। বাহারি ধরনের চুড়ি তৈরি হয় এসব কারখানায়। চকবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা মূলত এসব কারখানা থেকেই চুড়ি আনেন বিক্রির জন্য। এ ছাড়া আমদানিকারকদের কাছ থেকে ভারতীয় চুড়িও সংগ্রহ করেন তাঁরা।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় চুড়ির ব্যবহার শুরু হয় সেই প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার আগে থেকে। অতি পুরোনো আমলের যেসব মূর্তি পাওয়া গেছে, সেসব মূর্তির হাতেও চুড়ি দেখা গেছে।
তবে প্রাচীন যুগে নারীরাই যে কেবল নানা রকম সব চুড়ি পরতেন, এমন নয়। অলংকার হিসেবে নারীদের মতো তখন পুরুষেরাও চুড়ি পরতেন।