বাজারে এবার বেড়েছে আলুর দাম। গত দুই সপ্তাহে পণ্যটির দাম কেজিতে ১৫ টাকার মতো বেড়েছে। তাতে খুচরা বাজারে এক কেজি আলু ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে দুই মাস আগে পণ্যটির আমদানি শুল্ক কমিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর আমদানিও হয়েছে। তবে বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়নি; বরং দাম বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে হিমাগারে থাকা আলুর সরবরাহ শেষের দিকে। পাইকারি বিক্রেতারা চাহিদা অনুসারে আলুর সরবরাহ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে এ বছর অক্টোবর মাসে অতিবৃষ্টির কারণে আলুর বীজ রোপণে দেরি করেছেন কৃষকেরা। এতে বাজারে আগাম আলু আসতে দেরি হচ্ছে। এসব কারণে আলুর দাম বাড়ছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও–তালতলা ও মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। তবে বড় বাজার থেকে পাল্লা (৫ কেজি) হিসাবে কিনলে কিছুটা কমে পাওয়া যায়। ১৫ দিন আগে আলুর কেজি ছিল ৫৫-৬০ টাকা।
হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম বেড়ে ৬২ টাকায় উঠেছে। এমন দাম আগে কখনো দেখা যায়নি। আলুর বাড়তি চাহিদার কারণে মজুতদারেরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন।মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, সভাপতি, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন
কারওয়ান বাজারে আলুর পাইকারি বিক্রেতা জাহাঙ্গীর শিকদার বলেন, ‘হিমাগার থেকে চাহিদা অনুসারে আলুর সরবরাহ পাচ্ছি না আমরা। আবার দাম বেশি থাকায় আলুর বিক্রিও আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে।’
আলু সাধারণ তাপমাত্রায় বেশি দিন ভালো থাকে না। এ জন্য পণ্যটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে রাখা হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, সাধারণত নভেম্বরের শুরুতে নতুন আলু আসা শুরু করে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সরবরাহ পুরো স্বাভাবিক হয়ে যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ হিমাগারে আলু সংরক্ষণ শেষ হয়। কয়েক মাস বিক্রির পরে বছরের এ সময় এমনিতেই হিমাগারে থাকা আলুর সরবরাহ কমে আসে। এতে দাম কিছুটা বাড়ে। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন আলুর দাম অনেকটা বেশি।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাবে, গত বছর এই সময়ে খুচরা বাজারে আলুর কেজি ছিল ৪৫-৫০ টাকা, যা এখন ৬৫-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে এক বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। গত বছরও আলুর দাম বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছিল, তবে সেটা ডিসেম্বরের শেষ দিকে। অর্থাৎ এ বছর বেশ আগেই আলুর দাম বাড়ল।
আলুর মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আরও কিছু কারণের কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, সাধারণত বছরের এ সময়ে বাজারে আগাম (নতুন) আলু আসতে শুরু করে। এতে আলুর দামে একধরনের ভারসাম্য থাকে। তবে চলতি বছর অক্টোবর মাসে অতিবৃষ্টির কারণে আলুবীজ রোপণে দেরি করেছেন কৃষকেরা। এতে বাজারে আগাম আলু আসতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে চলতি বছর ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকেরা আগামী মৌসুমে আরও বেশি জমিতে আলু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বীজ আলুর সংকট থাকায় তাঁরা খাবারের জন্য রাখা আলুও বীজ হিসেবে কিনছেন। এসব কারণে আলুর সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে এবং বেড়েছে দাম।
এ বছর অক্টোবর মাসে অতিবৃষ্টির কারণে আলুর বীজ রোপণে দেরি করেছেন কৃষকেরা। এতে বাজারে আগাম আলু আসতে দেরি হচ্ছে। এসব কারণে আলুর দাম বাড়ছে।
আলু উৎপাদনের সরকারি-বেসরকারি তথ্যে গরমিল রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন। চলতি বছর আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ টন। তবে হিমাগারমালিকদের দাবি ভিন্ন। তাঁরা বলছেন, এ বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার তুলনায় ১০-১৫ লাখ টন আলুর ঘাটতি রয়েছে।
এদিকে স্থানীয় বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে গত সেপ্টেম্বর মাসে আলুর আমদানি শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক প্রজ্ঞাপনে (এসআরও) আলুর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করে। পাশাপাশি আলু আমদানিতে থাকা ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। কম শুল্কে আলু আমদানি হচ্ছে। যেমন গত ২৪ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ভারত থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ১০ হাজার টনের বেশি আলু দেশে এসেছে। আশা করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে বাজারে আলুর দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে দাম বেড়েছে।
চলতি বছর অক্টোবর মাসে অতিবৃষ্টির কারণে আলুবীজ রোপণে দেরি করেছেন কৃষকেরা। এতে বাজারে আগাম আলু আসতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে চলতি বছর ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকেরা আগামী মৌসুমে আরও বেশি জমিতে আলু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বীজ আলুর সংকট থাকায় তাঁরা খাবারের জন্য রাখা আলুও বীজ হিসেবে কিনছেন।
হিমাগারমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানান, গত জুন মাসে হিমাগার থেকে প্রতি কেজি আলু ৪২-৪৫ টাকায় পাইকারি বিক্রি হয়েছিল। সেই দাম এখন বেড়ে ৬২ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। হিমাগার পর্যায়ে এমন দাম আগে কখনো দেখা যায়নি। আলুর বাড়তি চাহিদার কারণে মজুতদারেরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন।
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, হিমাগার থেকে আলুর কেজিতে বাড়তি যে লাভ রাখা হচ্ছে, তার পুরোটাই মজুতদারেরা নিচ্ছেন। গত বছর এমন সময়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের তদারকির কারণে মজুতদারেরা এমন সুযোগ পাননি। কিন্তু এ বছর সে ধরনের অভিযান দেখা যায়নি।