গত দুই বছরে মোটরসাইকেলের দাম ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে মোটরসাইকেল বিক্রি কমেছে ৩২ শতাংশের মতো।
দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি ব্যাপকভাবে কমেছে। আগে বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর মোটরসাইকেল বিক্রিতে বছরে ১৫-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতো। এখন তা নেতিবাচক পর্যায়ে চলে গেছে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাস জানুয়ারি-অক্টোবরে এই খাতে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বিক্রি কমেছে ৩২ শতাংশ।
একদিকে ডলার-সংকট, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে দেরি হওয়া ও আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় মোটরসাইকেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে গ্রাহকেরা আগের মতো অর্থ খরচ করতে চাইছেন না। এর প্রভাব পড়েছে মোটরসাইকেলের বাজারে।
বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুই বছর আগে পর্যন্ত মোটরসাইকেল বিক্রিতে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি ছিল। কারণ, তখন মোটরসাইকেলের দাম কম ছিল। পাশাপাশি গ্রাহকেরাও তুলনামূলক স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু গত দুই বছরে মোটরসাইকেলের দাম প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই দাম বেড়েছে ৮-৯ শতাংশ; অর্থাৎ যে মোটরসাইকেলের দাম দুই বছর আগে ২ লাখ টাকা ছিল, সেটি এখন ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর—এই ১০ মাসে দেশে মোট ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৮৯২টি মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। ২০২২ সালের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার ২৮৫টি মোটরসাইকেল; অর্থাৎ এক বছরে মোটরসাইকেল বিক্রি কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। এটি কোনো বাজার জরিপ নয়; এই খাতের কোম্পানিগুলো তাদের বিক্রির তথ্য একত্র করে এই হিসাব জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সব কটি মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডেরই আগের তুলনায় বিক্রি কমেছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ব্র্যান্ডের বিক্রি ৪০ থেকে ৬০ শতাংশের মতো কমেছে। এ ছাড়া ভারত ও চীনের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিক্রিও ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
দেশে কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। সর্বশেষ অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। পাশাপাশি নির্বাচন ও সার্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ভোক্তারা তাঁদের খরচে কাটছাঁট করছেন।
জানতে চাইলে এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, বর্তমানে সার্বিকভাবে অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। এতে বিশেষ করে শহর অঞ্চলের গ্রাহকেরা বেশি চাপে রয়েছেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে মোটরসাইকেল বিক্রির ওপর।
গত বছরেও মোটরসাইকেলের বাজার ভালো যায়নি। ২০২২ সালে দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৬৮৯টি। এর আগের বছর বিক্রি হয়েছিল ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৯২৫টি মোটরসাইকেল; অর্থাৎ এক বছরে মোটরসাইকেল বিক্রি কমেছে ২৩৬টি।
দেড় বছর ধরে দেশে ডলারের দাম বাড়ছে। গত বছর মে মাসে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। সেই ডলার এখন ১১২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, সংকট থাকায় আরও বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে তাঁদের। দেখা যাচ্ছে, শুধু ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণেই আমদানি খরচ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ কিছু কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের কাঁচামাল ও সরবরাহের খরচ বেড়েছে।
টিভিএস অটো বাংলাদেশের সিইও বিপ্লব কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত দেড় বছরে আমাদের ৩০ শতাংশের বেশি খরচ বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা এই সময়ে কমেছে। তাই কোম্পানিগুলো মোটরসাইকেলের দাম ১২-১৪ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করতে পারেনি।’
২০১৮ সালে সরকার জাতীয় মোটরসাইকেলশিল্প উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করে। এতে দেশে ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ৫ লাখ এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ১০ লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের কথা বলা হয়।
এ নীতিমালায় সরকার দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদনে করছাড়, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছিল। চলতি ২০২৩ সালের শেষে মোটরসাইকেল বিক্রি ৫ লাখের নিচে থাকবে বলে ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক অনেক বেশি। এ পরিস্থিতিতে কিছুটা শুল্ক সমন্বয় করা গেলে এই খাতের উদ্যোক্তারা স্বস্তি পাবেন। পাশাপাশি মোটরসাইকেল নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধের অনুরোধও জানান তাঁরা।