মূল্যস্ফীতি গণনা

যেসব পরিবর্তন আসছে মূল্যস্ফীতি হিসাবের নতুন পদ্ধতিতে

মূল্যস্ফীতি
প্রতীকী ছবি

দেড় যুগ আগে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রচলন বাংলাদেশে তেমন একটা ছিল না। স্মার্টফোন ছিল না বললেই চলে। গত ১৬–১৭ বছরের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়েছে। স্মার্টফোন চলে এসেছে আমজনতার হাতে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো—কত কিছুই এসেছে এখন।

প্রবাসে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভিডিও কলের জন্য ইমো, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ যেন অপরিহার্য হয়ে গেছে। স্কুল–কলেজপড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী এখন অনলাইনে প্রাইভেট পড়ে। এসব চালাতে আমরা ইন্টারনেট সংযোগ নিই, কিংবা ‘এমবি’ কিনি। এসবে অনেক খরচ হয়। আপনার খরচের তালিকায় নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে এসব যুক্ত হয়ে গেছে।
আবার যাতায়াতের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। উবার–পাঠাও তো আছে। আগে যেখানে গ্রামগঞ্জে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক তেমন একটা দেখা যেত না, এখন এসব যানবাহনের সংখ্যা ব্যাপক বেড়েছে। ফলে আপনার যাতায়াতে বৈচিত্র্য যেমন এসেছে, খরচও বেড়েছে।

খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। ভাবুন তো, দেড় যুগ আগে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে তেমন একটা ফাস্ট ফুড–কফিশপ ছিল না। এমনকি মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানও খুব একটা বেশি ছিল না। এখন অহরহ এসব দেখা যায়। এর মানে, এসবের চাহিদা বেড়েছে, মানুষ টাকাও খরচ করছে।
আবার সরু চাল খাওয়া বেড়েছে। সয়াবিন ও পাম তেলের একচ্ছত্র বাজারে আঘাত হেনেছে রাইস ব্র্যান, সূর্যমুখী তেল। দৈনন্দিন জীবনে টিস্যু পেপার, বোতলজাত পানীয়, প্যাকেটজাত খাবার ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে।
দেড় যুগে এভাবেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও ভোগে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মূল্যস্ফীতির হার দিয়েই এসব মাপা হয়—কত খরচ বাড়ল, কত কমল। জিনিসপত্র বা সেবার মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নিজের আয় বৃদ্ধির সংগতি আছে কি না—এসবই মূল্যস্ফীতি গণনার ওপর নির্ভরশীল।

গণনায় পরিবর্তন আসছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি হিসাবে আমূল পরিবর্তন আনছে। ২০০৫–০৬ ভিত্তিবছর অনুযায়ী এখন মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়। এর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হবে ২০২১–২২ ভিত্তিবছর ধরে।
নতুন ভিত্তিবছরে গত দেড় যুগে মানুষের খরচের ধরনে যেসব পরিবর্তন এসেছে, তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন ২০০৫–০৬ ভিত্তিবছর মাত্র ৪২৬টি পণ্য ও সেবা দিয়ে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়। নতুন ভিত্তিবছরে আরও প্রায় ৩০০ পণ্য ও সেবা বাড়ছে। নতুন হিসাবে সব মিলিয়ে ৭২২টি পণ্য ও সেবা থাকবে।

এই ৭২২ পণ্য ও সেবাকে ১০০ পয়েন্ট ধরে মূল্যস্ফীতিতে এসব পণ্যের অবদান হিসাব করা হবে। এ ক্ষেত্রে চালের অবদান হবে ১৩। বাকি ৭২১টি পণ্য ও সেবার অবদান ৮৭। প্রথমবারের মতো খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার অবদান ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর মানে, মানুষ খাবার কেনার তুলনায় অন্যান্য পণ্য ও সেবা ভোগে খরচ বেশি করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভিত্তিবছর অবশ্যই দরকার। তবে খাদ্যপণ্যের তালিকা ব্যাপকভাবে বদলানো উচিত। এখন যে খাদ্যতালিকা আছে, এর ৮০ শতাংশই কার্বোহাইড্রেট–জাতীয় খাবার। ক্যালরির পরিবর্তে পুষ্টিমান দিয়ে খাদ্যপণ্যের তালিকা করা উচিত। এ নিয়ে সব অংশীজনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার।

কেন ভিত্তিবছর পরিবর্তন করতে হলো
কোভিড ও ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ছয় মাস ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। তখন থেকেই অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বর্তমান পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির সঠিক চিত্র উঠে আসে না। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) মূল্যস্ফীতি গণনায় ভিত্তিবছর পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। এই সংস্কার প্রস্তাব মেনে আগামী জুলাই মাস থেকে নতুন ভিত্তিবছর ও পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এর ফলে মানুষের ভোগ ও খরচের প্রবণতা আরও বেশি পরিষ্কার করে আসবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিবিএসের কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি গণনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক অর্থনীতিবিদের মধ্যে যে সন্দেহ রয়েছে, সেটা কমবে বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি গণনার ভিত্তিবছর পরিবর্তন, পণ্য ও সেবার তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে। আগামী মাস থেকে নতুন ভিত্তিবছরে মূল্যস্ফীতি গণনার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে।
আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা দিচ্ছে। গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের বোর্ড সভায় এ–সংক্রান্ত প্রস্তাবের অনুমোদন হয়। এর আগে প্রায় দুই মাস ধরে আইএমএফের শর্ত ও বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। তখনো মূল্যস্ফীতির ভিত্তিবছর পরিবর্তন ও প্রান্তিকভিত্তিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হিসাব করার কথা বলেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা।