ট্যারিফ কমিশনের তৈরি ৩৩০টি পণ্যের তালিকা নিয়ে কাজ করছে এনবিআর। গত মে মাসে ১৩৫টি পণ্যে শুল্ক বাড়ানো হয়।
আমদানি ব্যয় কমাতে আরও অনেক পণ্যে শুল্ক বাড়ানো নিয়ে কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত আগস্টে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন আমদানি নিরুৎসাহিত করা যায়, এমন ৩৩০টি পণ্যের তালিকা তৈরি করেছিল। এনবিআর সেই তালিকা ধরে এখন কাজ করছে।
আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এর আগে গত মে মাসে ১৩৫টি পণ্যে শুল্ক বাড়ায় সরকার। আরও কোন কোন পণ্যে শুল্ক বাড়ানো যায়, তার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করার জন্য গত ২০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি)। কমিশন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে পণ্যের একটি তালিকা তৈরি করে গত ৮ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেই তালিকা পাঠায় এনবিআরকে।
৭ নভেম্বর গণভবনে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ তালিকার কথাই বলেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। বুঝতেই পারেনি পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মাঝখানে ঠিক তালিকাই পাঠিয়েছিল। এটা আমলে নিলে পরিস্থিতি আরেকটু কম জটিল হতো।মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি
শুল্ক বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি কী পর্যায়ে আছে, জানতে চাইলে এনবিআরের শুল্ক বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। রাজস্বের ওপর কতটা প্রভাব পড়বে, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শিগগির এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বড় খাত আমদানি। বিপরীতে রপ্তানি, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণপ্রাপ্তির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আসে। দেশের আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে, কিন্তু রপ্তানি ও প্রবাসী আয় সেভাবে বাড়ছে না। এ কারণে বাণিজ্যঘাটতি বাড়ছে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে।
দেশে গত বছরের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০০ কোটি) ডলার, যা এখন ৩৪ বিলিয়ন (৩ হাজার ৪২৩ কোটি) ডলারে নেমেছে। সংকটের কারণে ডলারের দামও বাড়ছে। গত মে মাসে যে মার্কিন ডলার ৮৬ টাকা ছিল, তা এখন ১০৬ টাকা। এতে আবার আমদানি পণ্যের দাম বেশি পড়ছে।
দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। আগেই যখন আমদানি বাড়ছিল, তখন সতর্ক হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। শিল্পপতিরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরদর্শিতার অভাব এখানে প্রকট। আবার এমন অভিযোগও আছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম ধরে রেখেছিল। ডলারের বিপরীতে টাকার মান শক্তিশালী থাকলে রপ্তানি নিরুৎসাহিত হয়, আমদানি উৎসাহিত হয়।
ঠিক সময়ে কেন পদক্ষেপ নেওয়া হলো না আর ডলারের দামই বা কেন কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হলো, এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবির কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সক্রিয় হয় গত জুলাইয়ে। তখন গাড়ি, পানীয়, আসবাব, প্রসাধন, গৃহসামগ্রী, ফল ও ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণ পাওয়া যাবে না বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রয়োজন একেবারেই কম, এমন কিছু পণ্যে শতভাগ নগদ টাকা (মার্জিন) দিয়ে ঋণপত্র খুলতে বলা হয় প্রজ্ঞাপনে।
এর আগে গত মে মাসে সরকার যে ১৩৫ পণ্যে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়ায়, তার মধ্যে ছিল আসবাব; সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ব্যবহৃত প্রসাধনসামগ্রী, ফলমূল ও সমজাতীয় পণ্য।
৩৩০টি পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ করে দেওয়া প্রতিবেদনে ট্যারিফ কমিশন বলেছে, বিলাসী ও কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যকে এ তালিকায় রাখা হয়েছে। এগুলোর ওপর সাময়িক উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হলে দেশীয় শিল্পের ওপর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম।
কমিশনের প্রতিবেদনে যানবাহন, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, মূল্যবান ধাতু, প্রসাধন, পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সিরামিক পণ্য, সাজসজ্জা সামগ্রী, ফল ও ফুল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও পানীয়, টিনজাত খাদ্য, চকলেট, বিস্কুট, ফলের রস, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল–জাতীয় পানীয়, তামাক, তামাকজাত বা এর বিকল্প পণ্য ইত্যাদিতে আমদানি শুল্ক (সিডি), সম্পূরক শুল্ক (এসডি), নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) বাড়ানো এবং ট্যারিফ বা শুল্কায়নযোগ্য মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, সুপারিশ মানা হলে অন্তত ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় হতে পারে। বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতটুকু জানি, তালিকা অনুযায়ী কাজ করছে এনবিআর। কাজটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানকে আমি অনুরোধ করেছি।’
বিগত কয়েক মাসে দেশে আমদানি কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৮৭২ কোটি (প্রায় ১৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমদানি প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের মতো কমেছে। জানুয়ারি থেকে সংকট থাকবে না।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পণ্য বাছাই করে শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের বদলে এখন ঋণপত্র খোলাই কঠিন করে তোলা হয়েছে। এতে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও নিত্যপণ্যের আমদানিও কঠিন হয়েছে, যা শিল্প খাত ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ট্যারিফ কমিশন তিন মাস আগে যে তালিকা দিয়েছিল, সেটি ধরে শুল্ক বাড়ানো হলে এ পরিস্থিতি হতো না।
জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। বুঝতেই পারেনি পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মাঝখানে ঠিক তালিকাই পাঠিয়েছিল। এটা আমলে নিলে পরিস্থিতি আরেকটু কম জটিল হতো।
আমলে না নেওয়ার কারণ কী, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘পাকিস্তান ৩৫টি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধই ঘোষণা করেছে। আমরাও যদি একই ধরনের পদক্ষেপ নিতাম, অনেকে হয়তো এভাবে মেলাতেন যে আমাদের অবস্থাও বুঝি পাকিস্তানের মতোই খারাপ।
তা ছাড়া এখন কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না, আমার সন্দেহ আছে। গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তই আসে এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।’