বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর ঈদুল ফিতরের আগে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করার অনুমতি পেলেও তখন অনেকে দোকান নিয়ে বসেননি। অর্ধেক ফাঁকা পড়ে ছিল। যাঁরা ব্যবসা শুরু করেছিলেন, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে ভালো ব্যবসাও হয়নি তাঁদের। ঈদের পর তাই তোড়জোড় শুরু হয় বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরির। রোদ ও বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে ত্রিপলের ছাউনিও দেওয়া হয়। তাতে নতুনভাবে সেজেছে বঙ্গবাজার।
তবে যে কারণে এত আয়োজন, সেই ক্রেতাসমাগম এখনো কম বলে জানিয়েছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা।
আজ সোমবার সারা দিন বঙ্গবাজার ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে ব্যবসায়ীরা দোকান খুলে বসে আছেন। জানালেন, ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। তবু আশা নিয়ে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আগামী মাসের শুরুতে বেচাকেনা কিছুটা বাড়বে বলে প্রত্যাশা তাঁদের। এখন তাঁরা নতুন ঘরে ব্যবসা করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন।
কথা হলো খান গার্মেন্টসের বিক্রেতা মো. নাসিরের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি জানালেন, সকাল ৯টায় দোকান খুলে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত একটি পণ্যও বিক্রি করতে পারেননি তিনি।
‘সামনে আরেকটা ঈদ আসছে, আগে এ সময়ও কিছু বেচাকেনা হতো, এবার তা নেই। অনেকে জানেন বঙ্গবাজার পুড়ে গেছে, এ জন্য হয়তো আসছেন না। আমরা চেষ্টা করছি পরিচিত ক্রেতাদের জানাতে যে আমরা আবার দোকান নিয়ে বসেছি, ব্যবসায় ফিরতে চেষ্টা করছি,’ বলছিলেন তিনি।
একই অভিজ্ঞতা না হলেও বন্ধু ফ্যাশনের মনির হোসেনের অবস্থাও যে খুব ভালো গেছে তা বলা যাবে না। পাইকারি এই ব্যবসায়ী বলেন, সারা দিন অপেক্ষা করে বিকেল চারটার দিকে তিনি একজন ক্রেতা পেয়েছেন। পাইকারিতে তাঁর কাছে সাড়ে সাত হাজার টাকার প্যান্ট বিক্রি করেছেন তিনি। তাতে তাঁর ৪০০–৫০০ টাকা থাকবে।
মনির হোসেন বলেন, ‘সারা দিনের খরচ বাদ দিয়ে যা থাকবে, তা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতে হবে। এখন আমাদের দিনকাল এভাবেই চলছে, অথচ একটা সময় আমরা অনেক ভালো ছিলাম। ভাগ্য আজকে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আবার হয়তো কখনো ভালো দিন আসবে।’
বঙ্গবাজারের দোকানিরা এখন বসছেন বাঁশের তৈরি ঘরে। তবে স্থায়ী মার্কেট তৈরির জন্য এই স্থাপনা আবার ভেঙে ফেলতে হতে পারে—এমন খবরে ব্যবসায়ীদের অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক দেখা গেছে। কারণ, অনেকটা গুচ্ছ পদ্ধতিতে তৈরি এসব ঘরের পেছনেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরকে জনপ্রতি ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘দোকান চালুর পর থেকে কমবেশি কিছু ক্রেতা বঙ্গবাজারে আসছেন। তবে দোকান বসানোর সময়ই ব্যবসায়ীদেরকে বলা হয়েছে এই ব্যবস্থা অস্থায়ী। আর এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা করাও সম্ভব নয়। স্থায়ী সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আমরা নিয়মিত আলোচনা করে যাচ্ছি। আশা করি মার্কেট নির্মাণের দিনক্ষণ দ্রুত চূড়ান্ত হবে।’
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের আগুনে পুড়ে সব হারিয়েছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। নতুনভাবে শুরু করতে তাই এখানকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী ধারদেনার আশ্রয় নিচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের চেয়ে পারিবারিক সহায়তায়ই বেশি নিচ্ছেন।
ছাত্তার এন্টারপ্রাইজের আবদুস ছাত্তার প্রথম আলোকে জানান, তিনি কোনো অনুদান পাননি। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ করে ব্যবসা শুরু করার মতো পরিস্থিতিও তাঁর নেই। তিনি বলেন, ‘এদিকে হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। আশপাশের অনেকের কাছ থেকে ধারদেনা করে ৮০ হাজার টাকার মালামাল উঠিয়েছি।’
এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা ছাড়তে হবে—এমনটি মনে করছেন অনেক ব্যবসায়ী। মারহা প্যান্ট হাউস ও মাজিদ গার্মেন্টস নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক শেখ মনির বলেন, দুই দোকান মিলে তিনি এক হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত নন এই ব্যবসায়ী।
বেচাকেনা হচ্ছে না জেনেও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী বঙ্গবাজারে ব্যবসা শুরু করতে চাইছেন। তেমনই একজন মায়ের দোয়া গার্মেন্টসের মালিক মো. নেয়ামত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকেই গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছি। এখন মালামাল ওঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। ব্যবসা ভালো চলছে না জানি, তারপরও বসে থাকার উপায় নেই।’
নেয়ামত উল্লাহ মনে করেন, বেচাকেনা চালু করার পর শুরুতে সংসার খরচের টাকা হয়তো উঠবে না। তবে তাঁর নিজের খরচের টাকা উঠে আসবে সেই প্রত্যাশায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে চান এই ব্যবসায়ী।
তবে কিছু ক্রেতা কেনাকাটার জন্য বঙ্গবাজারে আসা শুরু করেছেন। তাঁদের একজন মোহাম্মদ ঈমন খান; ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও রাজধানীর ডেমরা এলাকার বাসিন্দা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পরিবারের সবার জন্য আমি বঙ্গবাজার থেকে কেনাকাটা করতাম। আজকেও বেশ কিছু কেনাকাটা করলাম।’ মার্কেট পুড়ে যাওয়ার পর গত ঈদে বঙ্গবাজার থেকেই তিনি কেনাকাটা করেছেন বলে জানান তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগর ও আদর্শ) মিলে দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবাজারে সব মিলিয়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মালপত্রের ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি। আর মার্কেটগুলোর কাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া দোকানের মালিক-কর্মচারীদের মানবিক ও মানসিক বিপর্যয়সহ ক্ষতির পরিমাণ এবং চাকরিহীনতার আর্থিক মাপকাঠি নিরূপণ করা দুরূহ বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।