জ্বালানি খাতের তিন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস বিক্রি করে সরকারের ঘাটতি এবং ভর্তুকির বিষয়টি বুঝতে চায় আইএমএফ।
দেশের জ্বালানি সরবরাহ ও সংকট পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। গতকাল বৃহস্পতিবার জ্বালানি খাতের তিনটি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে সফরকারী আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বৈঠক সূত্র বলছে, জ্বালানি তেল ও গ্যাস বিক্রি করে সরকারের ঘাটতি (লোকসান) এবং ভর্তুকির বিষয়টি বুঝতে চায় আইএমএফ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, জ্বালানি সরবরাহ, সংকট, আয়-ব্যয়, ভর্তুকির তথ্য জানতে দিনের শুরুতেই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ সময় দেশের জ্বালানি খাতের বর্তমান অবস্থা, গ্যাসের উৎপাদন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি, জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
এ খাতের আয়-ব্যয়সহ বিস্তারিত তথ্য নিতে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সঙ্গে আলাদা বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয় জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। বৈঠকে ছয় সদস্যের আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।
গত ২৬ অক্টোবর শুরু হওয়া আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বৈঠক চলবে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত। জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সঙ্গে ‘মিশন আপডেট’ নামে একটি বৈঠক করে সংস্থাটি।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ব্যয় পুরোপুরি বন্ধ করা, হুন্ডি ঠেকানো এবং কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো ছাড়া আইএমএফের দেওয়া অন্য শর্তগুলো পূরণ করাই হবে সমস্যা থেকে উত্তরণের বড় দাওয়াই।মাশরুর রিয়াজ, চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ
গতকালের বৈঠক শেষে পেট্রোবাংলা আইএমএফকে জানায়, গত জুনে গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাস বিক্রি করে ৭ থেকে ৮ টাকা লোকসান হচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছিল পেট্রোবাংলার। সরকার ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। আর বাকি টাকা জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল, গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত মুনাফা এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে একইভাবে ঘাটতি পূরণ করা যাবে কি না, জানতে চেয়েছে আইএমএফ। জবাবে পেট্রোবাংলা বলেছে, আগের মতো করে ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে না। কোম্পানির রিটেইন্ড আর্নিং (অবণ্টিত মুনাফা) সব সময় একই থাকে না। তাই দাম বাড়ানো না গেলে সরকারের কাছ থেকেই ভর্তুকি নিতে হবে। এ ছাড়া খরচ কমাতে ইতিমধ্যেই আমদানি কমানো হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করা হয়েছে গত জুলাইয়ে। সর্বশেষ তিন বছরে খাতভিত্তিক গ্যাসের দামের তথ্য নিয়েছে আইএমএফ। তবে বৈঠকে কোনো মতামত বা পরামর্শ দেয়নি প্রতিনিধিদল। এ ছাড়া দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চেয়েছে তারা। ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করে দিনে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিপিসি। গতকাল বিকেলে বিপিসির সঙ্গে বৈঠক করেছে আইএমএফ। এতে বিপিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। এতে গত ফেব্রুয়ারি থেকে লোকসান শুরু হয় বিপিসির। বৈঠক সূত্র বলছে, বিপিসির গত ১০ বছরের আয়-ব্যয়, ঋণ, লাভ-লোকসান ও ভর্তুকির বিষয়ে তথ্য নিয়েছে আইএমএফ। বিপিসি তাদের জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে ডিজেলের দাম এখন ১৩০ থেকে ১৩৫ ডলারে ওঠানামা করছে। এটি
১০৯ ডলারে নামলে বিপিসির লোকসান থাকবে না। তবে বর্তমানে বিপিসি সরকার থেকে কোনো ভর্তুকি নিচ্ছে না। নিজেদের জমা টাকা থেকে ঘাটতি পূরণ করছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এভাবে চলতে পারবে বিপিসি।
এলএনজি আমদানি মূল্য পরিশোধে গত তিন অর্থবছরে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়। যদিও ভর্তুকি পুরো দিতে হয়নি। অর্থ বিভাগ হিসাব করে দেখেছে, যে দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, সেই দামে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে বিক্রি করলে তাঁদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফের ঋণটা বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে। তবে এটা স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ, চলতি হিসাবের ঘাটতিটা অনেক বড়। এ ছাড়া প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। এ দুই সূচকে উন্নতির আশা কম। ফলে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ব্যয় পুরোপুরি বন্ধ করা, হুন্ডি ঠেকানো এবং কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো ছাড়া আইএমএফের দেওয়া অন্য শর্তগুলো পূরণ করাই হবে সমস্যা থেকে উত্তরণের বড় দাওয়াই।
আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার যদি তেল-গ্যাসের ভর্তুকি কমাতে গিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তো মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে—এমন প্রশ্নের জবাবে মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘সমস্যা থেকে বের হতে গেলে কিছুটা মূল্য পরিশোধ করতেই হয়। তবে আইএমএফ যে শর্তগুলো দেবে বলে শোনা যাচ্ছে, তা আমাদের এমনিতেই করার কথা।’