বিদেশি ক্রেতারা প্রতি পিস পোশাকে অতিরিক্ত ৭ সেন্ট করে দিলে বাড়তি মজুরি দিতে কারখানা মালিকদের ওপর চাপ পড়বে না বলে মনে করে সিপিডি।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে একটি শ্রমিক পরিবারের প্রয়োজনীয় খাবারের খরচ মাসে ১৬ হাজার ৫২৯ টাকা। আর খাদ্যবহির্ভূত খরচ ১২ হাজার ৮৮২ টাকা। একেকটি শ্রমিক পরিবারের গড় সদস্যসংখ্যা ৩ দশমিক ৭। তার মধ্যে উপার্জনক্ষম সদস্য ২। সেই হিসাবে শ্রমিকের মাসিক নিম্নতম মজুরি হওয়া দরকার ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশ্রমিকের নিম্নতম মজুরি নিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সংস্থাটি সর্বনিম্ন গ্রেডের জন্য সাড়ে ১৭ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব করে, যার ৫৫ শতাংশ মূল মজুরি এবং মূল মজুরির ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া।
এ ছাড়া মোট মজুরির ৭ শতাংশ খাদ্য ভাতা, ৫ শতাংশ চিকিৎসা ভাতা, সাড়ে ৩ শতাংশ যাতায়াত ভাতা এবং সন্তান লালন–পালনের জন্য ২ শতাংশ ভাতার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি ৫ ও ৬ নম্বর গ্রেডকে একীভূত করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
পোশাক খাতে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। তাঁদের মজুরি আরও বাড়ুক আমরাও চাই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আবার রপ্তানির ক্রয়াদেশ কম, সেটাও সত্য। ফলে এমন মজুরি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে তা দেওয়ার সক্ষমতা মালিকদের থাকে।ফারুক হাসান, সভাপতি, বিজিএমইএ
সিপিডি মনে করে, বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যদি প্রতি পিস পোশাকের জন্য মূল্য হিসেবে অতিরিক্ত ৭ সেন্ট করে দেয়, তাহলে বাড়তি মজুরি দিতে কারখানার মালিকদের ওপর কোনো চাপ পড়বে না।
রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে গতকাল রোববার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় ‘তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ অনুষ্ঠানে মজুরিসংক্রান্ত গবেষণার তথ্য তুলে ধরে সিপিডি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের ৭৬ কারখানা ও ২২৮ পোশাকশ্রমিকের ওপর করা জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণা করা হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহকারী তামিম আহমেদ। তাঁরা বলেন, জরিপে অংশ নেওয়া ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ কারখানার ব্যবস্থাপনায় যুক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে তাঁদের আপত্তি নেই। অন্যদিকে শ্রমিকদের প্রত্যাশা ১৮ হাজার ২৮৮ টাকা। আর বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন দাবি করেছে ২৫ হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরি।
তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে নিম্নতম মজুরি ৮ হাজার টাকা। পোশাকশ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণে ছয় মাস আগে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। ইতিমধ্যে এই বোর্ডে তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত শ্রমিক বা মালিক কোনো পক্ষই মজুরি প্রস্তাব দেয়নি। ফলে নতুন করে মজুরি বোর্ডের সময় বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে আয়োজন করা সিপিডির অনুষ্ঠানে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডির জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমানে পরিবারের প্রয়োজনীয় খাবারের ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত কেনার সক্ষমতা পোশাকশ্রমিকের রয়েছে। সে কারণে শ্রমিক পরিবারের ১২ শতাংশ দুধ ও ৫ শতাংশ চিনি প্রায় কেনেই না। এ ছাড়া ৫ শতাংশ শ্রমিক পরিবার কখনই ফল কিনতে পারে না। তবে শ্রমিক পরিবারগুলো প্রয়োজনের তুলনায় ৩১ শতাংশ চাল, ৫৫ শতাংশ আলু ও ৪৮ শতাংশ ভোজ্যতেল বেশি খায়। একই সঙ্গে প্রয়োজনের তুলনায় দুধ ৮৫ শতাংশ এবং ডিম ও মাছ ৪৯ শতাংশ কম খায়।
অবশ্য সিপিডির এই মজুরি প্রস্তাব অপর্যাপ্ত উল্লেখ করে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলেন, শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য ২৫ হাজার টাকা মজুরি দরকার।
শ্রমিকনেতা সাদেকুর রহমান বলেন, কম মজুরির কারণে স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করেও সন্তানকে নিজেদের কাছে রেখে মানুষ করতে পারছে না শ্রমিক পরিবার।
প্রবীণ শ্রমিকনেতা মন্টু ঘোষ বলেন, একটি যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণ করা হোক। গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার। তিনি আরও বলেন, পোশাকশিল্পের বড় সংকট হচ্ছে শ্রমিকেরা মুখ খুলে কথা বলতে পারেন না। এই খাতে অনেক উন্নতি হলেও শ্রমিকদের মধ্যে কথা বলার সংকট দূর হয়নি।
সিপিডির জরিপটি প্রতিনিধিত্বশীল হয়নি বলে মন্তব্য করেন মজুরি বোর্ডের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি দাবি করে বলেন, মজুরি নিয়ে সাধারণ শ্রমিকের মধ্যে অসন্তোষ নেই। শ্রমিকদের মজুরি ২৫ হাজার টাকা দিলে খুশি হতাম, শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। বেশি বেতন দিলে কারখানায় ঢুকলেই শ্রমিকের মুখে হাসি দেখতাম। শ্রমিকদের ভালো রাখতে ও ভালো দেখতে কে না চায়। তবে মজুরি এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে শিল্প বন্ধ না হয়ে যায়।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পোশাক কারখানার মালিকদের রক্ত চুষে নিচ্ছে। ৮০ শতাংশ মালিক কোনো রকমে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন। নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নের জন্য ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান যাতে ন্যায্য মজুরি দেয়, সে জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘পোশাক খাতে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। তাঁদের মজুরি আরও বাড়ুক আমরাও চাই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আবার রপ্তানির ক্রয়াদেশ কম, সেটাও সত্য। ফলে এমন মজুরি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে তা দেওয়ার সক্ষমতা মালিকদের থাকে।’
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জরিপে উঠে এসেছে, ২০১৯ সালের পর সপ্তম গ্রেড বা তার ওপরের পদে নিয়োগ পেয়েছেন, এমন ৪২ শতাংশ শ্রমিকের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরিকাঠামো পরিপালিত হয়নি। আবার ৪২ শতাংশ কারখানায় গ্রেড পদ্ধতি মানা হয় না। তাই এবারের মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নের জন্য ত্রিপক্ষীয় কমিটি করা দরকার। এ ছাড়া মজুরিকাঠামো কতটুকু বাস্তবায়িত হলো, তা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ছয় মাস পর প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা উচিত।