ডিম–ভাজির নাশতাও ৬০ টাকার নিচে নয়

একটি ডিমভাজির দাম গত এক বছরের ব্যবধানে ১৫–২০ টাকা থেকে বেড়ে এখন মোটামুটি ২৫ টাকায় স্থির হওয়ার পথে।

নাশতা
ছবি: সংগৃহীত

গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর মগবাজার এলাকার রেস্তোরাঁগুলোকে বরাবরের মতো ব্যস্তই দেখা গেল। নাশতা করা, সঙ্গে খাবারের দরদাম যাচাই করতে মোড়ের কাছে এক রেস্তোরাঁয় বসা গেল। খাবই খাব নামের ওই রেস্তোরাঁয় দুটি পরোটা, একটি ডিম ও ডাল-ভাজির নাশতার খরচ এল ৭০ টাকা। শুধু একটি ডিমেরই দাম রাখা হয়েছে ৩০ টাকা।

রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক সিদ্দিক খান প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বললেন, ডিম ভাজতে তেল, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ লাগে। ডিমের দাম বেড়েছে, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজের দামও বাড়তি। আর আমরা ডিম ভাজির জন্য বোতলের তেল ব্যবহার করি। তাই একটি ডিমভাজি ৩০ টাকা না রাখলে পোষায় না। আর রান্না করা ডিমের প্রতি বাটির দাম ৪০ টাকা।

যখন ১৬০ টাকায় এক ডজন ডিম কিনতে হয়, তখন আমি বুঝে উঠতে পারি না সাধারণ মানুষ কীভাবে তাঁদের সংসার চালাচ্ছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফা করার প্রবণতা থামাতে হবে।
গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

রাজধানীর মগবাজার, বাংলামোটর, পান্থপথের ক্যাফে নিউ স্টার, রায়তা, ক্যাফে ডার্লিং, বিসমিল্লাহ রেস্তোরাঁর মতো আরও ছয়টি রেস্তোরাঁয় গিয়ে জানা গেল, ডিমের দাম বাড়ানোর পর একটা ডিমভাজি অধিকাংশ রেস্তোরাঁয় ২৫ টাকা রাখা হচ্ছে। তবে দু-একটি রেস্তোরাঁ ডিমভাজির দাম এখনো বাড়ায়নি, আগের মতো ২০ টাকাই রাখছে। হুট করে দাম বাড়ালে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন—এই ভয়ে দাম বাড়াচ্ছে না এসব রেস্তোরাঁ। লাভের অঙ্ক কমলেও তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

মগবাজারের ক্যাফে নিউ স্টারের বিক্রেতা সাদেক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিমের দামে একটু স্থিতিশীলতা না এলে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে যেতে পারছি না। কারণ, বাজারটা বেশি অস্থির। আরও দু-একটি দিন দেখে তারপর দাম বাড়াতে হবে।’

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে দেশের বাজারে আটা-ময়দার দাম বাড়ার পর রেস্তোরাঁয় একেকটা পরোটার দাম ৫ থেকে বেড়ে ১০ টাকায় উঠেছে। আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ১০ টাকার ডাল-ভাজি এখন হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। ডিমভাজির দাম গত এক বছরের ব্যবধানে ১৫ থেকে ২০ টাকা হয়ে এখন মোটামুটি ২৫ টাকায় স্থির হওয়ার পথে। তাতে দুই পরোটা, ডাল-ভাজি ও একটি ডিম দিয়ে এখন সকালের নাশতা করতে চাইলে ৬০ থেকে ৬৫ টাকার নিচে সম্ভব হচ্ছে না।

পান্থপথে নাশতা সেরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ক্লাস থাকলে সকালের নাশতা রেস্তোরাঁয় করতে হয়। সাধারণ মানের নাশতা করে একটা চা-কফি খেলেই প্রায় ১০০ টাকা চলে যায়। আগে এই টাকায় দুপুরের খাবার হয়ে যেত।

মেসের খরচ বাড়িয়েছে ডিম

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকালের বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ১৫৯ থেকে ১৬৫ টাকা। টিসিবির হিসাবে, বাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দামের প্রায় সমান হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে যাঁরা মেসে থাকেন, তাঁদের খরচ আগের থেকে বেড়েছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাংলামোটর এলাকার একজন মেস বাসিন্দা জিয়াউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেসে আমরা প্রতি বেলায় ১০ থেকে ১২ জন খেয়ে থাকি। এখন যদি ডিম দিয়ে এক বেলা খাই, তাহলে শুধু ডিম বাবদ খরচই আসে ১৭০ টাকার মতো। কিন্তু দেড় কেজি ওজনের একটা ব্রয়লার মুরগি আনলে তার দাম পড়বে ২৫০ টাকার মতো। তাতে মুরগিটা দুই বেলা খেলে প্রতি মিল খরচের পরিমাণ কমে আসে। অর্থাৎ ডিমের চেয়ে মুরগি খেলেই বরং খরচ কম পড়ে।’

বাজারে অধিকাংশ নিত্যপণ্য উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল। গত বছর থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। এর মানে হলো, দেশের মানুষকে এক বছর ধরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব। তা থেকেই অনুমেয়, নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কতটা বেশি। উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহব্যবস্থা এবং আয় বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বাড়া-কমার ওপর প্রভাব রাখে। বাজারের বর্তমান যে পরিস্থিতি, সেই বাস্তবতায় শিগগিরই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে—এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ২ হাজার ৩৩৫ কোটি। অর্থাৎ সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে।

এর মধ্যে গত এক বছরে দামও বেড়েছে কয়েক দফা। দেশে উৎপাদিত এই ডিম দিয়েই চাহিদা মিটলেও বাজারে নানা সময়ে ডিমের বড় উত্থান-পতন দেখা গেছে।

এ বিষয়ে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন ১৬০ টাকায় এক ডজন ডিম কিনতে হয়, তখন আমি বুঝে উঠতে পারি না সাধারণ মানুষ কীভাবে তাঁদের সংসার চালাচ্ছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফা করার প্রবণতা থামাতে হবে।’