ছয়টি সরকারি চিনিকলে প্রায় চার বছর ধরে আখমাড়াই বন্ধ রয়েছে। এসব চিনিকল পর্যায়ক্রমে আবার চালুর চিন্তাভাবনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের কার্যক্রম শুরু করেছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনে সরকারি মোট ১৫টি চিনিকল রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টির কার্যক্রম বন্ধ আছে। এগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বন্ধ থাকা চিনিকলগুলোর বেশির ভাগই বর্তমানে উৎপাদনের উপযোগী অবস্থায় নেই। আর দীর্ঘ সময় উৎপাদন বন্ধ থাকায় চিনিকলসংশ্লিষ্ট এলাকায় আখের উৎপাদনও কমেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিএসএফআইসি সূত্র জানায়, বন্ধ থাকা কারখানাগুলো চালুর আগে আখের উৎপাদন বৃদ্ধি, কারখানা সংস্কার ও নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন করা আবশ্যক। এ জন্য কয়েক শ কোটি টাকা লাগবে। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই প্রাথমিকভাবে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জের মধ্যে যেকোনো একটি চিনিকল চালুর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে বিএসএফআইসি। এতে সব মিলিয়ে ৩৫ কোটি টাকার মতো লাগতে পারে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ বছর একটি চিনিকল চালুর উদ্যোগ নেওয়ার মানে হচ্ছে, চলতি চাষ মৌসুমে প্রয়োজনীয় আখ চাষের ব্যবস্থা করা হবে। পরবর্তী মাড়াই মৌসুমে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) ওই কারখানায় আখমাড়াই ও চিনির উৎপাদন সম্ভব হবে। আর এ বছর আখ রোপণ বাড়ানো না গেলে এই প্রক্রিয়া এক বছর পিছিয়ে যাবে।
বিএসএফআইসির সচিব মো. আনোয়ার কবীর প্রথম আলোকে বলেন, বন্ধ কারখানা চালুর বিষয়ে কার্যক্রম ইতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠনের নির্দেশনা এসেছে। এ মাসের মধ্যেই কমিটি গঠন করা হবে।
প্রথমে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকলের যেকোনো একটি চালুর চিন্তা।
একটি টাস্কফোর্স গঠনের কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
১৫টি সরকারি চিনিকলের মধ্যে চালু আছে ৯টি।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আখের সংকট ও লোকসানের কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৬টি চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আনে জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ। সংগঠনটির নেতারা বন্ধ চিনিকলগুলো চালুর দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এর পাশপাশি তাঁরা শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের কাছে স্মারকলিপি দেন। পরে উপদেষ্টার নির্দেশে করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করে সংগঠনটি।
জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আবদুল্লাহ আল কাফি রতন জানান, ‘বন্ধ থাকা চিনিকলগুলো কীভাবে লাভজনকভাবে চালু করা যায়, সেটি পর্যালোচনার জন্য বৈঠকে একটি টাস্কফোর্স গঠনের জন্য আমরা বলেছি। মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানিয়েছে। টাস্কফোর্সে রাখার জন্য আমরা অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কয়েকজন সদস্যের নাম প্রস্তাব করেছি; বাকি সদস্যদের ঠিক করবে বিএসএফআইসি।’ চলতি সপ্তাহের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
দেশে গত এক দশকে চিনির দাম দেড় শ গুণ বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি আখের দাম। এ কারণে অনেক আখচাষি বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন আখের উৎপাদন কমছে। আখের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকার কারণেই মূলত ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেয় সরকার। ফলে নতুন করে চিনিকল চালু করতে হলে আখের উৎপাদন বৃদ্ধি করা আবশ্যক বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর সঙ্গে চিনিকলের যন্ত্রপাতিরও আধুনিকায়ন করতে হবে।
এ বিষয়ে আবদুল্লাহ আল কাফি রতন বলেন, ‘চিনিশিল্পকে বাঁচাতে হলে সব কটি চিনিকল চালু করা জরুরি। তবে একসঙ্গে সব কটি কারখানা চালু করার বাস্তবতা নেই, এটা আমরাও বুঝি। এ জন্য প্রাথমিকভাবে একটি বা দুটি কারখানা চালু করার দাবি জানিয়েছি। তাতে আশপাশের এলাকা থেকে সেখানে আখ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’
এদিকে চিনিকল নিয়ে বিতর্কিত এস আলম গোষ্ঠীর সঙ্গে করা একটি সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) বাতিল করেছে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। আখের উৎপাদন বৃদ্ধি ও লোকসানে থাকা চিনিকলকে আধুনিক করতে বিএসএফআইসি ও এস আলম অ্যান্ড কোম্পানির মধ্যে গত ৪ জুলাই ওই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল।
সমঝোতা অনুসারে, কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আখের উৎপাদন বৃদ্ধি, আধুনিক আখ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন, ছয় মেগাওয়াট অ্যাগ্রোভোলটাইক সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন, বাইপ্রডাক্ট প্রসেসিং প্ল্যান্ট ও প্যাকেজিং কারখানা করার প্রস্তাব করেছিল এস আলম গ্রুপ। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওই সমঝোতা চুক্তি বাতিল করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এস আলম গ্রুপের বিষয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে এমওইউ বাতিল করা হয়েছে। আর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এমওইউ করলেও চিনিকলগুলোর মালিকানা বদলের বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। তাই কোনো জটিলতা ছাড়াই ওই এমওইউ বাতিল করা গেছে।