বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক লেনদেনে রুপির ব্যবহার শুরু হয়েছে। দুই দেশের সরকারই এই বন্দোবস্তকে মাইলফলক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলছে, এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়বে এবং ডলারের আধিপত্য পাশ কাটিয়ে নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য করা সম্ভব হবে।
ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ এখন ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। এই বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বাণিজ্য রুপিতে করতে পারবে; অর্থাৎ ভারতে দেশটি যে পরিমাণ রপ্তানি করে, সেই পরিমাণ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার।
আল–জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির দিকে নিশানা করে বাংলাদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত বিশ্লেষক এই বন্দোবস্ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করছেন, এই বন্দোবস্তের কারণে ভারত নিঃসন্দেহে লাভবান হবে এবং রুপিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রায় রূপান্তর করার তার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা গতি পারে, কিন্তু বাংলাদেশের বিশেষ লাভ হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রুপিতে বাণিজ্য করে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে না। বাস্তবতা হলো, প্রতি মাসেই রিজার্ভ কমবেশি কমছে।
রিজার্ভের হ্রাস ঠেকাতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আমদানি সীমিত করেছে। কিন্তু তাতেও বিশেষ কাজ হয়নি, কারণ রিজার্ভের ৭৫ শতাংশই হচ্ছে ডলার; অন্যদিকে টাকার দরপতন চলছেই। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ শতাংশের বেশি কমেছে।
ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেন ইউয়ানে নিষ্পত্তি করার অনুমতি দিয়েছে। এতে ইউয়ানের মজুত বেড়েছে; ২০১৭ সালে যা ছিল মোট মজুতের ১ শতাংশ, ২০২২ সালে তা ১ দশমিক ৩২ শতাংশে উন্নীত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক আল–জাজিরাকে বলেন, ‘রুপির লেনদেন আমাদের ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের আরেকটি উপায়।’
তবে বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন চিন্তা করছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘হিসাবটা খুব সরল। ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা টাকায় রপ্তানির বিল না নিলে ভারতের সঙ্গে আমাদের যে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য ঘাটতি, তা ডলার দিয়েই নিষ্পত্তি করতে হবে। তাতে আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে বলে আমার মনে হয় না।’
তবে রুপির ব্যবহার বাধ্যতামূলক না হওয়ায় এতে বাংলাদেশের ‘দৃশ্যত ক্ষতি’ হবে না বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি আরও বলেন, ‘ভারত নিজের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক করতে চায়, সেদিকে লক্ষ রেখেই তারা উদ্যোগ নিচ্ছে। বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সম্ভবত তাকে সহায়তা করছে।’
আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ী বলছেন, রুপিতে বাণিজ্য করে তাঁরা লাভবান হবেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক কারখানা এমবি নিট ফ্যাশনের মালিক মোহাম্মদ হাতেম আল–জাজিরাকে বলেন, সরাসরি রুপিতে বাণিজ্য করার কারণে তাঁর অন্তত ৬ শতাংশ ব্যয় বেঁচে যাবে।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, কাঁচামালের বড় অংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। আগে টাকা থেকে ডলার এবং রুপি থেকে ডলারে রূপান্তর করতে হতো, এই প্রক্রিয়ায় প্রতি ১০০ ডলারে ৬ ডলার ব্যয় হতো। এখন সরাসরি রুপিতে লেনদেন করা গেলে সেই ব্যয় আর হবে না।
এ বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করেন জাহিদ হোসেন। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ভারত থেকে আমদানির মূল্য ডলারেই পরিশোধিত হবে, তবে রুপিতে নিষ্পত্তি করা যাবে। অর্থাৎ আগেও একবার মুদ্রার রূপান্তর হতো, এখনো একবারই হবে; এ ক্ষেত্রে শুধু মুদ্রা ভিন্ন হবে।’ ফলে লেনদেনে ব্যয় কীভাবে বাঁচবে, সেটা ঠিক তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়।
আর্থিক খাত বিশ্লেষক জিয়া হাসান আল–জাজিরাকে বলেন, একটি বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। সেটা হলো, রুপিতে বাণিজ্য করে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর চাপ তেমন একটা কমবে না। আমদানি থেকে যেটা বাঁচবে, রপ্তানিতে তা ব্যয় হয়ে যাবে। আবার রুপির অবমূল্যায়ন হলে বাংলাদেশের যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রুপি আছে, তারা ক্ষতির মুখে পড়বে।
এ ছাড়া ভারতের অনেক রপ্তানিকারকও রপ্তানি মূল্য ডলারে বিপরীতে রুপিতে না–ও নিতে পারেন।
ডি-ডলারাইজেশন বা ডলারে ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে ভারত এখন ১৮টি দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করছে—জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মতো দেশও সেই তালিকায় আছে। গত বছরের জুলাই মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এ লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার পর রুপিতে বাণিজ্য গতি পেয়েছে।
তবে অনেক বিশ্লেষক আবার মনে করেন, একাধিক মুদ্রায় বাণিজ্য করার চেয়ে এক মুদ্রায় বাণিজ্য করা লাভজনক; সেই সঙ্গে বিষয়টি স্থিতিশীল। এতে লেনদেনের ব্যয় কম হয়। এ ছাড়া রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের ব্যবহার নিয়ে যে একধরনের অলিখিত ঐক্য আছে, তা–ও খুব শক্তিশালী।