বিদেশি ব্যাংকগুলো সুদ ও মাশুল বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকে ব্যাংক ঋণসীমাও কমিয়ে দিয়েছে। এতে আমদানি খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
বিদেশি কয়েকটি ব্যাংক দেশের ব্যাংকগুলোকে নতুন করে ঋণসুবিধা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক যে ঋণসীমা (ক্রেডিট লাইন) দিয়ে রেখেছিল, তা-ও ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের কিছু ব্যাংক আমদানি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। আমদানিতে খরচও বেড়ে গেছে। এ কারণে ঋণপত্র খোলাও কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বিদেশি ব্যাংকের সহায়তায় পণ্য আমদানি করে থাকে। আবার বিদেশি ব্যাংকগুলো আমদানি দায় পরিশোধের জন্য দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যাংকগুলোকে ঋণও দিয়ে থাকে। এর বিনিময়ে কমিশন ও সুদ নেয় তারা। ঝুঁকি বেশি হলে সুদ ও কমিশনও বেড়ে যায়। এতে আমদানি খরচ আরও বেড়ে যায়।
গত জুন মাস থেকে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ওই সময় থেকে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। এরপর অস্বাভাবিক মুনাফা করার অভিযোগে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকসহ ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের আমদানি-বাণিজ্যে অন্যতম অংশীদার, যার সহায়তায় অন্য ব্যাংকগুলো আমদানি দায়ের নিশ্চয়তা দেয় ও দায় পরিশোধ করে। এই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর বিদেশি ব্যাংকগুলোর আস্থা আরও কমেছে।
একাধিক ব্যাংকের এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা ডলার বাজার নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংক হুকুমের মাধ্যমে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। যে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তাতে বিদেশি ব্যাংকগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবেই।জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ
তবে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি আনিস এ খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ডলারে মুনাফার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে বিদেশি ব্যাংকগুলো মনে করছে, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি কোনো দেশের অর্থনীতিতে একটু অস্থিরতা দেখা দিলে বিদেশি ব্যাংকগুলো পর্যবেক্ষণ করে। এই সময় তারা সেবা খরচ ও সুদহার বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে পুরো চাপ গিয়ে পড়ে আমদানিকারকদের ওপর। এতে পণ্যের দামও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পন্ন করে থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাশরেক ব্যাংক। ব্যাংকটি সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর লেনদেনের সীমা ২৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। বৈশ্বিকভাবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন কমিয়ে এনেছে। তারা দেশের ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে ঋণ দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোকে ১০ লাখ ডলারের বেশি ঋণ দেওয়ার আগে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককে ভারতে অবস্থিত তাদের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে পৃথক অনুমোদন নিতে হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার আরএইচবি ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঋণসহায়তা পেত। ব্যাংকটির সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া শাখার মাধ্যমে এসব লেনদেন হতো। তবে গত মাসের শুরু থেকে ব্যাংকটি নতুন করে লেনদেন বন্ধ করে দেয়।
ভারতের রাষ্ট্র খাতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঋণসুবিধা (ইউপাস ঋণপত্র) দিত। তারাও নতুন করে কোনো ইউপাস ঋণপত্র দিচ্ছে না। এ ছাড়া ভারতের এক্সিস ব্যাংক, আইসিআইসিআই ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য দেওয়া সুবিধার সীমা কমিয়ে আনছে, নতুন করে কোনো লেনদেন করতে চাইছে না। ভারতের এইচডিএফসি ব্যাংকও লেনদেন করতে চাইছে না।
কোরিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (কেডিবি) বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ঋণের সীমা পুরোপুরি বাতিল করেছে। এখন শুধু এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) নিশ্চয়তার বিপরীতে ঋণসুবিধা দিচ্ছে।
এদিকে আগে ঋণপত্রের বিল পরিশোধের নিশ্চয়তার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলো লাইবরের সঙ্গে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ নিত। তা বেড়ে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। তবে ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়ে বলে, সুদ লাইবরের সঙ্গে ৩ শতাংশের বেশি হবে না। এ জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলো লেনদেন কমিয়ে দেয়। এতে ঋণপত্র খোলাও কমে গেছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো এত কম সুদে বিল পরিশোধের নিশ্চয়তা দিতে চাইছে না।
বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক গড়ে উঠলেও বড় মূলধনের ও আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক হয়নি। ফলে বিদেশি বড় ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া বৈদেশিক লেনদেন সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে আমদানির জন্য যে ঋণপত্র খোলা হয়, তার বড় অংশই বিলম্বে পরিশোধের। ক্ষেত্রবিশেষে ৩৬০ দিন পরও বিল পরিশোধ করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিদেশি কোনো ব্যাংক ঋণ দেয়, তার বিপরীতে সুদ পায়।
বৈদেশিক বাণিজ্য করতে গেলেও বিদেশি ব্যাংকের সহায়তা লাগবেই। এসব ব্যাংক ঋণপত্রের নিশ্চয়তা দেয়, আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ঋণসুবিধাও দেয়। এসব ব্যাংকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর হিসাবও (নস্ট্রো) থাকে। এই হিসাব থেকে দেনা পরিশোধ করা হয়। এ জন্য যার যত বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি, সেই ব্যাংক বিদেশি বাণিজ্যে তত শক্তিশালী।
যেমন বেসরকারি খাতের ইস্টার্ণ ব্যাংকের এমন ৫৯৪টি ব্যাংকের চুক্তি রয়েছে। আবার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২০১৯ সালে ৪২০টি বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি ছিল। ২০২১ সালে যা কমে হয়েছে ৩৮৮টি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের প্রধান বলেন, যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে ডাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়, তখন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংক বাংলাদেশকেও চেনে না, এই দেশের ব্যাংককেও না। এ জন্য আন্তর্জাতিক কোনো ব্যাংকের সহায়তা লাগে সেই ঋণপত্রের নিশ্চয়তার জন্য। আবার বিলম্বে পরিশোধ করতে চাইলে বিদেশি কোনো ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে। এ জন্য বিদেশি ব্যাংক ছাড়া বিদেশি বাণিজ্য করা সম্ভব নয়।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হেলাল আহমেদ চৌধুরী এ নিয়ে বলেন, বিদেশি ব্যাংকগুলো যাতে দেশি ব্যাংকগুলোকে খারাপ চোখে না দেখে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
ডলারের সংকট কাটাতে কিছু পণ্যের ঋণ বন্ধ বা মার্জিন হার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার আগে যাচাই করে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার কেনাবেচার মাধ্যমে অস্বাভাবিক মুনাফা করায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি ডলারের মুনাফা ব্যাংকের আয়ে না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ট্রেজারি প্রধানেরা সব বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন। হঠাৎ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে। এ কারণে সুবিধা কমিয়ে দিচ্ছে বিদেশি ব্যাংকগুলো।
দেশের ডলার-সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের দামও ৮৬ থেকে ৯৫ টাকায় উন্নীত করেছে। যদিও ব্যাংকগুলো আমদানি খরচে ডলারের দাম ১০৬-১০৭ টাকা পর্যন্ত রাখছে। আমদানির রাশ টানতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ঋণপত্র খোলা কমেছে। পাশাপাশি বেড়েছে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি। এরপরও ডলারবাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলার কেনাবেচা শুরু হয়নি। ব্যাংকগুলো এখনো ১১০ টাকার বেশি দামে প্রবাসী আয় আনছে। আনুষ্ঠানিক দামের চেয়ে আমদানি খরচে প্রতি ডলারে ১১-১২ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। সংকটের কারণে অনেক আমদানি দায় পরিশোধের সময় পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সামনের দিনে আবারও একসঙ্গে বড় চাপ তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্যঅর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে প্রথমআলো কে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হুকুমের মাধ্যমে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।যে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তাতে বিদেশি ব্যাংকগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবেই।এত পদক্ষেপের পরও কি বাজার স্বাভাবিক হয়েছে?
তাহলে অনেক পদক্ষেপ নিশ্চয়ই ঠিক ছিলনা। মুদ্রাকে ওঠানামা করার জন্য জায়গা দিতে হয়, তাহলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়। অন্য কিছু হলে বিদেশিরা ভালো চোখে দেখেনা।এর ফল ভালো হয়না।