শেয়ারবাজারের টানা দরপতনের প্রতিবাদে ডিএসই ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন একদল বিনিয়োগকারী। গতকাল দুপুরে মতিঝিলে
শেয়ারবাজারের টানা দরপতনের প্রতিবাদে ডিএসই ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন একদল বিনিয়োগকারী। গতকাল দুপুরে মতিঝিলে

পতনেও থেমে নেই কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের মানববন্ধন

শেয়ারবাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠকের পরদিনও বাজার পড়েছে। সূচক যেভাবে টানা পড়ছে, সেটিকে বড় ধস মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। তাই দরপতনের প্রতিবাদে আবারও রাস্তায় নেমেছেন কিছু বিনিয়োগকারী।

শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে করণীয় নির্ধারণে গত সোমবার বাজার অংশীজনদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানায় বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার আহ্বানে বিনিয়োগ বাড়ানোর তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অংশীজনেরা। সেই প্রতিশ্রুতির পরও গতকাল মঙ্গলবার বাজারে পতন হয়েছে।

প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এ দিন ৪১ পয়েন্ট বা পৌনে ১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৩৪ পয়েন্টে। গত ৩৫ মাসের মধ্যে এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ এ সূচক ২০২১ সালের ৬ মে ৫ হাজার ৬০৬ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। ঢাকার বাজারের পাশাপাশি সূচক কমেছে চট্টগ্রামের বাজারেও। সিএসইর সার্বিক সূচকটি ৩৪ পয়েন্ট কমেছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাজারে দরপতন শুরু হয়। এর পর থেকে বেশির ভাগ দিনই বাজার পড়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত শেয়ারবাজারে মোট ৫১ দিন লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ দিনই বাজারে দরপতন হয়। এ দরপতনে পুঁজি হারানো একদল বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারী গতকাল ঢাকার মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেছেন। এ সময় তাঁরা পতন ঠেকাতে ও শেয়ারবাজারে কারসাজি বন্ধে ব্যর্থতার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ বেশ কিছু দাবি জানান।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এ মানববন্ধন দুপুর পৌনে ১২টায় শুরু হয়ে পৌনে ১টায় শেষ হয়। তাঁদের দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল কারসাজি বন্ধ করা, নামসর্বস্ব ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানির তালিকাভুক্তি বন্ধ করা, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা ও জেড শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি তালিকাচ্যুত করা।

মানববন্ধনকালে তাঁরা বিএসইসির চেয়ারম্যানসহ পুঁজিবাজার–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ দাবি করেন। এ সময় তাঁরা বলেন, ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে বাজারে ধস নেমেছিল। ২০২৪ সালে এসেও একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অথচ কারসাজির মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্যোগ ও বাজারের টানা দরপতন বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে আমরা চেষ্টা করছি। তারই অংশ হিসেবে সোমবার অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। আশা করছি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়লে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।’

দরপতনের বাজারেও যে নানা ধরনের কারসাজির ঘটনা ঘটছে, তার প্রমাণ মেলে দুর্বল ও মানহীন কিছু কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনায়। ঢাকার বাজারে গতকাল মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে আসার আগে জালিয়াতি করে সম্পদ মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়েছিল। এ কারণে অনুমোদনের পর কোম্পানিটির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও বাতিল করা হয়েছিল। বিএসইসির তদন্তেও এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। পরে জালিয়াতি সংশোধন করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। আইপিওতে কোম্পানিটি ২০ টাকায় প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করেছিল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। গত ৬ মার্চ লেনদেন শুরুর পর মাত্র ২৯ কার্যদিবসে এটির শেয়ারের দাম বেড়ে হয়েছে ৫৬ টাকা। সেই হিসাবে ২৯ দিনে এটির শেয়ার দাম বেড়ে তিন গুণ হয়েছে।

লেনদেনের শীর্ষ পাঁচ কোম্পানির তালিকায় আরও ছিল গোল্ডেনসন। কোনোরকমে ব্যবসায় টিকে থাকা কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ভালো কোনো লভ্যাংশও দিতে পারে না। তারপরও দেড় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ঢাকার বাজারে গতকাল মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক কোম্পানি বিডি থাই ফুড। অগ্রণী ব্যাংকের ঋণখেলাপি এ কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলেছিল ঋণ পরিশোধের কথা বলে। কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে ১৫ কোটি টাকা তুললেও ব্যাংকের ঋণ আর শোধ করেনি। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে এসেছিল জাহিদ মালেক মন্ত্রী থাকাকালে। সেই কোম্পানি সর্বশেষ ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের মাত্র ৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। গতকাল দরপতনের মধ্যেও সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম এক দিনেই ১০ শতাংশ বেড়েছে।

মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় আরও ছিল সালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও ফার্মা এইড নামের দুর্বল মানের কোম্পানি। ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের সিকিউরিটিজ আইন পতিপালন করতে না পারা কোম্পানি দুটির উদ্যোক্তাদের যেখানে শাস্তি পাওয়ার কথা, সেখানে তারা পুরস্কৃত হচ্ছে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিতে। সালভো কেমিক্যালের শেয়ারের দাম গত ১১ দিনে ১১ টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে গতকাল এক দিনেই বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি। আর ফার্মা এইডের শেয়ারের দাম গত তিন দিনে ৯০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭০০ টাকা।

নিম্নমানের কোম্পানির শেয়ারের দাম যেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেখানে টানা দর হারাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, গ্রামীণফোন, রবি, বার্জার, ট্রাস্ট ব্যাংক, বেক্সিমকো ফার্মাসহ ভালো মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানি। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেসব শেয়ারে কারসাজিকারকেরা সক্রিয় রয়েছেন, সেসব শেয়ারের দামই অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরে বাজে কোম্পানি বা জাঙ্ক শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছে। যতই দিন যাচ্ছে, এ ধরনের কারসাজির ঘটনা ততই বাড়ছে।’ তিনি মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূচক বাড়াতেই বেশি ব্যস্ত, কারসাজি রোধে তাদের কোনো পদক্ষেপই নেই। যত দিন এ ধরনের কারসাজি থাকবে, তত দিন বাজার ঠিক হবে না।