আজ শ্রম উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ‘বর্তমান শ্রম পরিস্থিতি’ শীর্ষক বৈঠক বসছে। এতে আগের সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়নের চিত্র উঠে আসবে।
নিম্নতম মজুরি, হাজিরা বোনাস, মামলা প্রত্যাহারসহ ১৮টি বিষয়ে তৈরি পোশাক খাতের মালিক ও শ্রমিকেরা যে সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন, দেড় মাস পার হলেও সেগুলোর বেশির ভাগই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা-সংঘাত ও শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষ ওই সমঝোতায় পৌঁছায়। সরকারের এক মূল্যায়নে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত মাত্র সামান্য কয়েকটি বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে।
সমঝোতায় পৌঁছানো ১৮টি বিষয়ের অন্যতম ছিল শ্রম আইন সংশোধন করা। সরকারের পরিকল্পনা ছিল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এটি সংশোধন করা হবে। তবে আগামী মার্চ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া পিছিয়ে গেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে গত বুধবার পাওয়া এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ১৮টি বিষয়ের কিছু পদক্ষেপের আংশিক বাস্তবায়ন হলেও বাকিগুলোর জন্য কাজ করছে বিভিন্ন কমিটি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ‘শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় শ্রমিক ও মালিকপক্ষের যৌথ ঘোষণা হয়। ওই ঘোষণায় ২৫টি বিষয় জায়গা পেলেও ২৪ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মালিক ও শ্রমিকেরা ১৮টি বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছান ও চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলে যে অসন্তোষ দেখা দেয়, তা সমাধানের জন্যই সরকারের উদ্যোগে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে ওই আলোচনা হয়।
ক্ষুধার্ত মানুষ চুপ করে থাকতে পারে না। মুদিদোকানি অপমান করছেন, বাড়িওয়ালা অপমান করছেন, অথচ কারখানা মালিকের কাছে মজুরি পান শ্রমিক। এ শ্রমিকের ক্ষোভ কমানো যাবে তাঁর বকেয়াটা পরিশোধ করেই।সৈয়দ সুলতান আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক, বিলস
গত দেড় মাসে ১৮টি বিষয়ের বাস্তবায়নে কতটা অগ্রগতি হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে আজ রোববার ‘বর্তমান শ্রম পরিস্থিতি’ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আবার একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে শ্রমিক ও মালিকদের যৌথ ঘোষণার বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
শ্রম উপদেষ্টা ও শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানসহ ৯ সদস্যের একটি দল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে যোগ দিয়ে দুই দিন আগে দেশে ফিরেছে। আজ অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সেই অভিজ্ঞতা নিয়েও আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় দুই মাস আগে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন চিত্র কাল (আজ) জানা হবে। তবে কারখানায় মজুরি না দেওয়ার তুলনায় দেওয়ার হারই বেশি। যে কয়েকটি কারখানায় এখনো মজুরি বকেয়া রয়েছে, তারাই ঝামেলা করছে।
শ্রমিকদের জন্য রেশন দেওয়ার বিষয়ে মালিকপক্ষ খুব একটা এগিয়ে আসছে না বলে জানান সচিব সফিকুজ্জামান। তবে তিনি বলেন, ১৮টি বিষয় নিয়েই কাজ চলছে। সব পক্ষের সহযোগিতা থাকলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
গত অক্টোবর মাসের মধ্যেই পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নের ঘোষণা ছিল। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ২ হাজার ১৪০টি কারখানার মধ্যে ২ হাজার ১২১টি তা বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ১৯টির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন এবং বিষয়টি তদারক করা হচ্ছে।
শ্রমসচিব সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯টির মধ্যে দুটি কারখানায় বকেয়া মজুরি পরিশোধের বিষয়টির ইতিমধ্যে সমাধান হয়েছে। বাকি কারখানাগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে।
নিম্নতম মজুরি পুনর্মূল্যায়নের জন্য ছয় মাসের মধ্যে একটি সক্ষমতা প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের তিনজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে এটি তৈরি হবে। এখন পর্যন্ত কমিটির দুটি বৈঠক হয়েছে। এ ছাড়া বার্ষিক নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ কমিটি মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় রেখে চলতি মাসের মধ্যে শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে বলে কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে কাজ চলছে বলে মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি বিষয়ে শ্রম আইন সংশোধন হওয়ার কথা। এগুলো হচ্ছে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা, তাঁদের সার্ভিস বেনিফিট দেওয়া এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন করা।
শ্রমসচিব বলেন, ‘আইএলও পর্ষদ সভায় আমরা জানিয়ে এসেছি, অধ্যাদেশ জারি হতে মার্চ নাগাদ সময় লাগবে।’
মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে অনেক কারখানা ১২০ দিন মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া শুরু করেছে। সংশোধিত শ্রম আইনে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সার্ভিস বেনিফিট বলতে স্থায়ী, অস্থায়ী ও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চাকরি করা শ্রমিকদের ইস্তফা দেওয়ার সুযোগ এবং বিপরীতে মজুরি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ বছর কাজ করলে তাঁদের যে এককালীন সুবিধা পাওয়ার কথা, সেটি এখানে থাকবে। সংশোধিত শ্রম আইনে এ বিষয়গুলো যোগ করে অধ্যাদেশ জারি করা হবে। শ্রম আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্যায্যভাবে ছাঁটাই হচ্ছে না। ছাঁটাই হলেও আইনানুগ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের।
সমঝোতা বৈঠকে শ্রমিকদের জন্য রেশনব্যবস্থা চালু করতে মালিকদের কাছে প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পাশাপাশি সব পোশাক কারখানায় শ্রমিকের হাজিরা বোনাস, টিফিন ও নাইট বিল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রেশনের বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। তবে হাজিরা বোনাসসহ বিল বৃদ্ধির বিষয়ে কারখানাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তা বাস্তবায়নের বিষয়ে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে তদারকও করা হচ্ছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছিল, শ্রমঘন এলাকায় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হবে এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিও শ্রমঘন এলাকায় সম্প্রসারণ করা হবে। কাজটি হয়েছে বলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জুলাই-আগস্টে গণ-আন্দোলনে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা দিতে একটি তালিকা হওয়ার কথা। এ তালিকা পরে যাবে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এ। শ্রমিকনেতাদের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো এটি চূড়ান্ত করেনি।
এদিকে রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে যে কমিটি রয়েছে, সেই কমিটি একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ক্ষতিপূরণ দিতে অনেক টাকা অনুদান পেলেও খরচ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। মালিক-শ্রমিকের সমঝোতায় বিষয়টি সুরাহা করার জন্য এলেও বিষয়টিতে কোনো অগ্রগতি নেই।
২০২৩ সালের মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলনসহ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আগে অনেক হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার কথা ছিল। মজুরি আন্দোলনে মারা যাওয়া চারজন শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে তথ্য যাচাইয়ের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠিয়েছে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে।
জানা গেছে, শ্রমিক সংগঠন ও শ্রম অধিদপ্তর যৌথভাবে মামলার তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। এখনো তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যায়নি। এ বিষয়ে নতুন করে অভিযুক্তদের শ্রম মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত মামলা আছে ৪২ জনের বিরুদ্ধে। তালিকা পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে সেগুলো আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। এরপর মামলা বাতিলের গেজেট হবে।
মামলা প্রত্যাহার নিয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হয়রানিমূলক মামলাগুলোতে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগপত্র (চার্জশিট) হয়নি। ফলে বিষয়টা খুবই সহজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে থানাগুলোতে একটা চিঠি দিলেই মামলাগুলোয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব।’
ঝুট ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে চাঁদাবাজি হয়। চাঁদাবাজি বন্ধে কেন্দ্রীয় তদারক ব্যবস্থা তৈরি করার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রম অধিদপ্তর ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে একটি রূপরেখা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুই দপ্তর এখন এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।
কারখানায় নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানার মালিকেরা বিষয়টি সমাধান করবেন। বিজিএমইএকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে দুই পক্ষসহ সরকারকেও সক্রিয় হতে হবে। এই সময়ে কোনো কোনো ব্যবসায়ী যৌক্তিক কারণে অসুবিধায় থাকলেও কেউ কেউ আবার সুযোগ নিচ্ছেন। মজুরি বকেয়া রাখার কোনো অধিকার কারও নেই। মজুরি না দিলে শাস্তি—সরকারের দিক থেকে এটাই দর্শন হওয়া উচিত।
বকেয়া বেতন পরিশোধ, কারখানা বন্ধ না করা এবং ছাঁটাই না করা—এ তিন বিষয়ে জোর দিয়ে সৈয়দ সুলতান আহমেদ বলেন, ‘ক্ষুধার্ত মানুষ চুপ করে থাকতে পারে না। মুদিদোকানি অপমান করছেন, বাড়িওয়ালা অপমান করছেন, অথচ কারখানা মালিকের কাছে মজুরি পান শ্রমিক। এ শ্রমিকের ক্ষোভ কমানো যাবে তাঁর বকেয়াটা পরিশোধ করেই।’ তিনি আরও বলেন, এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় সরকারের দিক থেকে এমন একটি তহবিল গঠন করা দরকার, যেখানে প্রত্যেক কারখানার শ্রমিকদের জন্য দুই মাসের মজুরি জমা থাকবে।