তাঁর মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের কাছে অর্থনীতির অবিসংবাদিত শিক্ষাগুরু। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তারও আগে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত তিনি তৈরি করেছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্বের’ প্রণেতা হিসেবে।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একাধিক বই ও লেখায় সেই সময়কার অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিনিময়ের যেসব খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া যায়, তা থেকেই বোঝা যায়, তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর কতখানি আস্থা রাখতেন বঙ্গবন্ধু।

সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের এযাবৎকালের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর মতো প্রভাবশালী আর কেউ ছিলেন না। সেটি উন্নয়ন–গবেষণার ক্ষেত্রেই হোক, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেই হোক বা বাংলাদেশের স্বার্থে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই হোক।

তিনি চাইলে পৃথিবীর সেরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বা আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চ পদে থেকে কর্মজীবন পার করে দিতে পারতেন। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করার তাগিদেই ওই সব কোনো পদে নিজের পেশাগত স্বার্থে লেগে থাকেননি তিনি। সারা জীবন তাঁর মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে।

স্কুলজীবন থেকে শুরু করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শেষ করা পর্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম তুখোড় প্রফেসর হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রবাদতুল্য।

আমার মতো অনেকেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, তিনি কর্মজীবনের শেষটা অনেকটা স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকলেও প্রতিনিয়ত দেশের উন্নতির জন্য কতটা ভাবতেন, উদ্বিগ্ন থাকতেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, দেশের নীতিনির্ধারকদের গঠনমূলক পরামর্শ দিতে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের স্বার্থে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। সভা-সেমিনারে যেকোনো মঞ্চে আমন্ত্রণ পেলেই দেশে ছুটে এসেছেন, স্বাস্থ্যগত বা অন্য নানা বাধা উপেক্ষা করে।

দু-একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ না বললেই নয়। যখনই যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়েছি, তাঁর বাসায় থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির হালচাল নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নেওয়া এবং মতবিনিময় করা। এ অভিজ্ঞতা আমার মতো অনেকেরই থেকে থাকবে।

আমাকে তিনি প্রায়ই একটি উপদেশ দিতেন, ‘ওয়াহিদ, সরকার আগ্রহ না দেখালে, নিজে যেচে পরামর্শ দিতে যাবে না। তাহলে মনে করবে, তুমি কোনো পদ-পদবি চাইছ।’ বোধ হয় এই উপদেশ ছিল তাঁর একধরনের অভিমান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আর কখনোই করা হয়নি।

মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনি ই–মেইলে লিখেছিলেন, ‘বৃদ্ধ বয়স খুব কষ্টের, আমার দিন শেষ হয়ে আসছে।’ তাঁর কথাই ঠিক হলো। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই।

  • ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা