অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কথা বলেছেন চলমান অর্থনৈতিক সংকটের নানা দিক নিয়ে। বিশ্লেষণ করেছেন কেন এমনটা হলো আর আগামী দিনের করণীয় নিয়ে। সাক্ষাৎকার গ্রহণে শওকত হোসেন
প্রথম আলো: বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে সংকট বলি বা টানাপোড়েনই বলি না কেন, আসলে সমস্যার ধরন ও গভীরতা বোঝা দরকার। সমস্যার উৎপত্তি যে বাহ্যত বিশ্ব অর্থনীতির বিরূপ পরিস্থিতি থেকে, সেটি আমরা সবাই জানি। তবে পূর্ববর্তী এক দশক বা এরও বেশি সময়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলোও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী। দৃশ্যমান টানাপোড়েনের মধ্যে আছে—প্রথমত, ডলারের দাম হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে, বিশেষত খোলাবাজারে। এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ আছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের বাজারে। এর ওপর আবার বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বিশেষ করে ডিজেলের মতো বহুল ব্যবহৃত উপকরণের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর কারণে পুরো অর্থনীতির ওপরে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপরে অসহনীয় চাপ পড়েছে। এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। যেমন আর্থিক খাতের সমস্যা, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, বিদেশের অর্থ পাচার—এগুলো সবই বহুদিনের সমস্যা। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণ নিয়েও বিতর্ক আছে। এ ছাড়া চলমান ও প্রস্তাবিত অবকাঠামো তৈরির মেগা প্রকল্পের অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের সময়সূচির প্রশ্ন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষত আইএমএফ থেকে ঋণ চাওয়ার প্রেক্ষাপট—এসব কিছু নিয়েও একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব সমস্যা একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। আলাদা আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিকল্পগুলোর কোনোটাই খুব স্বস্তির বা সুখকর কিছু হয় না; বরং কম অপ্রিয় বিকল্পগুলো থেকেই বেছে নিতে হয়, অস্বস্তিটা সেখানেই। এ জন্যই নির্ভরযোগ্য তথ্য–উপাত্ত এবং গভীর বিচার–বিশ্লেষণ খুব জরুরি।
আপনি সংক্ষেপে পুরো সমস্যার কথা বললেন। কয়েকটা বিষয় নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই। যেমন ডলারের দাম ও রিজার্ভের ওপর চাপ। আশঙ্কা আসলে কতটা?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বহু বছর ধরে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স মিলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে আমরা ভালো অবস্থানে ছিলাম। আবার প্রতিবছর আমরা যে বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য নিয়েছি, সেটি মূলত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য, বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনে নয়। এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত বেড়েছে। কিন্তু গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে পরিস্থিতি পুরো বদলে গেছে। যদিও এ সময় আগের তুলনায় অনেক বেশি নিট বৈদেশিক ঋণ পেয়েছি, যা ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো হবে।
এই নিট ঋণ বিগত বছরগুলোর তুলনায় দুই-তিন গুণ বেশি। এত বেশি ঋণ নিয়েও কিন্তু লেনদেনের ঘাটতি মেটাতে পারিনি; বরং রিজার্ভ আরও কমেছে। বর্তমান অর্থবছরেও বৈদেশিক লেনদেনের এই প্রবণতাগুলো অব্যাহত আছে এবং এভাবে চলতে থাকলে আরও ঋণ বা সাহায্য নিলেও রিজার্ভে ক্রমাগত টান পড়তেই থাকবে। বিশেষ করে সামনের বছরগুলোতে যখন ঋণ পরিশোধের দায় আরও বাড়বে। তবে শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার যে সমস্যা বা পাকিস্তান যে অবস্থার কাছাকাছি, আমাদের সমস্যা সে রকম নয়। তারা কিছুটা বেহিসাবি হয়ে ঋণ নিয়ে, সেই ঋণ পরিশোধের দায় মেটাতে গিয়ে একরকম ঋণের বেড়াজালে আটকে গিয়েছিল। আমাদের সমস্যা কিন্তু এখনো ঋণ পরিশোধের সমস্যা নয়, যদিও বার্ষিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কিছুটা বাড়ছে। তিন-চার বছর পরে এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। সুতরাং এখনই সতর্ক না হলে ঋণ পরিশোধের দায় পরে সমস্যা তৈরি করবে।
আমাদের এখনকার সমস্যা তৈরি হয়েছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায়। ফলে আগের চেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ পেলেও তা দিয়েও চলতি আয়ের বিপুল ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছে না। ফলে এখনো রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার ছাড়তে হচ্ছে। তাতেও ডলারের দাম স্থিতিশীল করা যায়নি। তবে আশার কথা হলো, এ বছরও আমাদের রপ্তানি যথেষ্ট বেড়েছে। যদিও তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানির ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে। তবুও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি যদি বাড়ে, তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি আসবে। আবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সও বাড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশ্বমন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এসব কারণে আমরা যদি বড় ধরনের নীতিগত ভুল না করি, তাহলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না।
রিজার্ভ নিয়েও তো প্রশ্ন উঠেছে। সমস্যা তো বিনিময় হার নিয়েও।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: রিজার্ভ এবং টাকার বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় আমরা কিছু ভুল করেছি। হয়তো রিজার্ভ বাড়তে থাকায় একটা অতিরিক্ত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ এসে গিয়েছিল। আমাদের মতো একটি দেশে রিজার্ভ বাড়ানো হয় ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতাদের আস্থা তৈরি করতে। রিজার্ভকে সরকারের বাজেট সম্পদের মতো প্রকল্পে বিনিয়োগের সম্পদ মনে করা ঠিক নয়। আমরা কিন্তু সে রকম চিন্তা করেছি। সম্ভবত রিজার্ভের কোনো একটি অংশ কোনো না কোনো ভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ জন্যই ব্যবহারযোগ্য প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া একসঙ্গে আমরা অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছি, ঋণের দায় শোধের চিন্তা ততটা না করেই।
ভারতে ১৯৯০ সালে এক বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল। সে দেশের অর্থনীতি আমাদের তুলনায় সাত গুণ বড়। তারা এখন ৬০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রিজার্ভ বাড়িয়েছে। তারপরেও ভারতে ডলারের দর বেড়েছে এবং রিজার্ভ কমেছে, কিন্তু সেটি উৎকণ্ঠার কারণ হয়নি; কিন্তু আমরা ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার ছেড়েছি। এর বদলে যদি ক্রমান্বয়ে ডলারের দর বাড়তে দেওয়া হতো, আর বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ আরও বাড়ানো হতো, তাহলে ডলারের দামের সংকট হঠাৎ এত তীব্রভাবে অনুভব করতে হতো না; বরং তাতে অর্থনীতিও বেশি দামের ডলারের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ পেত, আতঙ্কও তৈরি হতো না।
অন্যান্য দেশেও ডলারের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমাদের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে, যেখানে শিল্পের কাঁচামাল, উপকরণ, খাদ্যপণ্য, সার—সবকিছুই আমদানি করতে হয়, সেখানে ডলারের দাম মূল্যস্ফীতিতে বড় চাপ তৈরি করে। আমরা এখন ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে খোলাবাজারে দামের বড় পার্থক্য দেখছি, হয়তো কিছুটা আতঙ্কের কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। আবার কিছুটা পরিষ্কার নীতির অভাবেও ডলারের বাজারে জল্পনাকল্পনা তৈরি হয়েছে এবং অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এখন হুন্ডির মাধ্যমে পুঁজি পাচারও অনেক সহজ হয়ে গেছে।
বিশ্ব অর্থনীতি ও সরকারের কিছু সিদ্ধান্তে তো মূল্যস্ফীতির চাপও বাড়ছে
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: আমাদের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে ডলারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সম্পর্ক সরাসরি। এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের আমদানি করা অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি তেল, বিশেষত যেভাবে মাত্রাতিরিক্তভাবে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পুরো অর্থনীতিতে একধরনের অস্থিরতা ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আতঙ্ক অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।
দেখছি যে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি তেলের সমস্যার কারণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে, শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, এতে আমাদের রপ্তানির প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও কিছুটা কমছে। জ্বালানির দাম এভাবে অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেওয়ায় আমাদের জ্বালানি নীতি নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। আমি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু দু-একটি বিষয় সবার নজরে এসেছে। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা যেভাবে বেড়েছে, কিন্তু প্রাথমিক জ্বালানির উৎস বা সরবরাহের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য দেখা যাচ্ছে না। এর বাইরে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কিছু ব্যবসায়ীকে একচেটিয়া সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি চুক্তিও তাদের অনুকূলে করা হয়েছে। এতে বাজেটে বড় অঙ্কের ব্যয় বেড়েছে। অথচ গ্যাসের অনুসন্ধান না করে আমরা আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি, বিশেষত তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি), ডিজেল, জ্বালানি তেল—এগুলোর ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এখন বিপদে পড়ে আমরা গ্যাস অনুসন্ধানের পরিকল্পনার কথা বলছি, যা বাস্তবায়ন করলেও সুফল পেতে কয়েক বছর সময় লাগবে
জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়াতে হলো কেন বলে মনে করেন?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ডিজেলের দর হঠাৎ এতটা বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সম্ভবত সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আয়কর বা মুনাফার ওপর কর অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কর আদায়ের দুর্বলতার কারণে আমরা আমদানি শুল্ক ও ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করেছি বেশি। অথচ নীতিগতভাবে ভ্যাট তো শুধু ভোগ্যপণ্যের ওপরে আরোপ করার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে জ্বালানির মতো অতি প্রয়োজনীয় একটি পণ্য, যাকে বলে সর্বজনীন উৎপাদন উপকরণ, তার ওপর কর বসিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হয়েছে। এটা ৯০–এর দশকে ভ্যাট প্রবর্তনের পর থেকেই হয়ে আসছে, ক্রমান্বয়ে তা আরও বেড়ে গেছে। এটা ঠিক যে ডিজেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের দামে ডিজেল বিক্রি করলেও আমাদের দাম বাড়াতে হতো না, যদি না আমরা রাজস্ব সংগ্রহের জন্য জ্বালানির ওপর এত নির্ভরশীল না হতাম। জ্বালানির ওপর যে কর, সেটি সমন্বয় করলে জ্বালানির দাম আসলে এত বাড়ানোর দরকার হতো না।
যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি দাম কম ছিল, তখন সরকারি সংস্থা বিপিসি একচেটিয়া সরবরাহকারী হিসেবে অনেক মুনাফা করেছে। জ্বালানি বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা কোনো ভালো নীতি নয়। জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ দরকার হলে প্রয়োজনে অন্যান্য প্রকল্পের মতো বাজেট বরাদ্দ থেকেই তা দেওয়া উচিত। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দেওয়া হচ্ছে।
জ্বালানির অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি তো কৃষি খাতকেও সংকটে ফেলবে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: কেবল ডিজেলের দাম নয়, সারের দামও বাড়ানোর কারণে কৃষির উৎপাদন খরচ বাড়ছে। বিষয়টা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। এখনো আমরা চাল ও গম আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করি। সেখানেও দাম বেড়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এবার বর্ষাকালে বৃষ্টি খুব কম হয়েছে। এর ফলে বিশেষ করে উঁচু জমির যে আমন, যেখানে সেচের প্রয়োজন বেড়েছে। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে সেখানে কৃষকদের সমস্যা হবে। তার থেকেও বড় কথা হলো, এই বর্ষাকালের বৃষ্টি জমিতে আর্দ্রতা রেখে দেয়, যাকে ‘রেসিডুয়াল ময়েশ্চার’ বলে, যার ফলে বোরো উৎপাদনে কম সেচ দিলেও হয়, হয়তো সেখানেও সমস্যা দেখা দেবে।
তা ছাড়া সার ও খাদ্যশস্য গুদামজাত করার ক্ষমতা আমাদের খুব সীমিত। এখন বিশেষ ভর্তুকির কথা বলা হচ্ছে। এটা কৃষকের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, যারা মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের সহায়তার জন্য রেশনিংয়ের কথা বলা হচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু অর্থ কোথা থেকে আসবে? এ জন্য এখন বাজেটের ঘাটতি বাড়লে আবার মূল্যস্ফীতি হবে, এটাও তো একটা দুষ্টচক্র। এই একটা জায়গাতে অবশ্য আমাদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার একটা মিল আছে। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় আমাদের যেখানে ১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় সেখানে ১২ শতাংশর মতো। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এই দুটি দেশই সবচেয়ে কম রাজস্ব আয় করে।
সমস্যা তো আর্থিক খাতেও প্রকট
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এখানে উন্নতির বদলে অবনতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা। এর সঙ্গে পুঁজি পাচারের একটি বড় সম্পর্ক আছে। পুঁজি পাচার রোধে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সরকারের এ ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার আছে কি না, বলা মুশকিল। আমরা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকে বড় অঙ্কের লেনদেনের রেকর্ড রাখার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে তো গায়েব হতে পারে না। এর একটা পদচিহ্ন ওই লেনদেনের হিসাবের মধ্যে পাওয়া যায়। আমরা এগুলো খতিয়ে দেখলে পুঁজি পাচারের প্রক্রিয়াগুলো অন্তত বুঝতে পারব। আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং রোধ, বিদেশে নামে মাত্র সহযোগী হিসেবে স্থানীয় উদ্যোক্তা খুঁজে নিয়ে কোম্পানি খুলে মুনাফা হস্তান্তর করে হোক বা হুন্ডির মাধ্যমেই হোক, অর্থ পাচারের প্রক্রিয়াগুলো সম্বন্ধে যদি আমাদের ধারণাই না থাকে, তাহলে আমরা পুঁজি পাচার বন্ধ করব কী করে। এ ধরনের লেনদেন বিশ্লেষণ করলে কারা এ জন্য দায়ী সেটিও কিছু কিছু শনাক্ত করা সম্ভব।
মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশ্বের অনেক দেশ সুদহার বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ বাড়াবে না বলে দিয়েছে। কী করা প্রয়োজন?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: সুদের হার নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। কোভিড অতিমারির সময়ে ব্যবসা ও শিল্প খাতকে দেওয়া প্রণোদনার অংশ হিসেবে সুদের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে আগের মতো এত সহযোগিতার দরকার নেই। তা ছাড়া সুদহার নিয়ে বিতর্ক আমরা আগেও করেছি। ৮০-এর দশকে বাজারমুখী সংস্কারের অংশ হিসেবে তখন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে কয়েকটি অগ্রাধিকার খাত বাদ দিয়ে সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তখনো সুদের হারের উচ্চসীমা বেঁধে দেওয়া বা সীমা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হয়েছিল, যা এখন আমরা আবার নতুন করে করছি। সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া যুক্তি হলো, বাজারে যে সুদহার হওয়ার কথা, সেটি যদি আমরা কমিয়ে রাখি, তাহলে প্রভাবশালী বড় ব্যবসায়ীরাই বেশি ঋণ নিয়ে যাবেন। অথচ ঋণের প্রাপ্যতা অনুযায়ী অন্যরা, যাঁদের মধ্যে ভালো উদ্যোক্তা থাকতে পারেন, যাঁদের বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা হয়তো বেশি, তাঁরা হয়তো বঞ্চিত হবেন। অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা অনুযায়ী আর্থিক সম্পদের দক্ষ বণ্টন হয় না। এটাই হচ্ছে সুদের হার উদার করার পেছনে অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকের যুক্তি। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এই যুক্তিই অনুসরণ করে।
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় অন্য একটা দিক আছে। সুদের হার একদম যদি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, যাঁরা খুব ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প নিতে চান বা যাঁরা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, আগে থাকেই জানেন যে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেবেন না, অথবা অনেকবার পুনঃ তফসিল বা রিশিডিউল করে সুদের হার অনেক কমিয়ে নেওয়া যাবে। অনেকবার রিশিডিউল করলে, সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ধরলে অনেক সময় প্রকৃত সুদহার ঋণাত্মকও হয়ে যায়। বড় বড় ঋণখেলাপি সবার ক্ষেত্রেই তা–ই হয়েছে। আরেক দল আছে, আর যাঁরা ঋণ নিয়ে পুঁজি পাচার করেন। তাঁরাই আসলে ঋণ নিয়ে যাবে। আবার যাঁরা আসলেই ভালো বিনিয়োগকারী, তাঁরা তো এত উচ্চ হারে ঋণ নিয়ে পোষাতে পারবেন না।
সুতরাং আমাদের দেশের বাস্তবতায় দেখেশুনে মাঝামাঝি একটি অবস্থানে থাকলেই আমরা সুফল পাব। কাজেই এখন যে সুদহার বেঁধে দেওয়া আছে, তা তুলে দেওয়া উচিত। তার মানে এই নয় যে আমরা পর্যবেক্ষণ করব না। তুরস্ক আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত দেশ। কিন্তু সেখানেও একটা অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। আমাদের সঙ্গে তার কিছু মিলও আছে। সুদের হার বেঁধে দেওয়া কিন্তু জনতুষ্ট নীতি, ব্যবসায়ীদের কিছুটা খুশি করার বিষয়ও তা। তুরস্কে পরপর তিনজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এরদোয়ান সরকার কর্তৃক পদচ্যুত হয়েছিলেন; কারণ, তাঁরা সুদহারের সীমা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। আমাদের এখানে এখন বরং আরেকটা সীমা করে দিতে পারে।
বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিয়েও আলোচনা কম হচ্ছে না। আমরা কি এ পথেও সংকট তৈরি করলাম?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: সংকটের জন্য অনেকে বড় অবকাঠামোর প্রকল্পের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। আমরা রিজার্ভের ভালো অবস্থা দেখে হয়তো অতিরিক্ত উৎসাহে অনেক বেশি বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে ফেলেছি, যার ঋণের দায় পরিশোধ করতে হবে। এই প্রকল্পগুলোর অগ্রাধিকার নির্ণয় ও ব্যয় সাশ্রয়ে আরও মনোযোগ দেওয়ার দরকার ছিল। তবে এটা ঠিক যে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে এর লাভ-ক্ষতি নির্ণয় জটিল বিষয়। তা ছাড়া এটা অনেক বেশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবু বড় প্রকল্প নিতে গেলে অর্থায়নের কথা ভাবতে হবে। আবার এ ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পের কারণে যাতায়াতের সুবিধা বাড়ে, মানুষের এই লাভ দৃশ্যমানও হয়। তবে অর্থনৈতিক বিচারে এত ব্যয়ের প্রকল্পগুলোর আসল লাভালাভ নির্ভর করে এর ফলে বিনিয়োগ কতটা উৎসাহিত হলো, তার ওপর। বিশেষ করে এর ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগ বাড়লে তাহলেই কেবল বৈদেশিক লেনদেনে ঋণের বোঝা সমস্যা হয় না। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেছে।
বড় অবকাঠামোর ক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয় যে পৃথিবীতে যত বড় বড় মেগা প্রকল্প হয়েছে, সেটা নদীর ওপর হোক, স্থলপথ দিয়ে উড়াল এক্সপ্রেসওয়ে হোক, আমরা যদি তালিকা করি, দেখা যাবে উন্নয়নশীল দেশেই এগুলোর সংখ্যা বেশি। এই তালিকায় চীন থাকলেও অন্য দেশগুলো চীনের মতো এত দ্রুতগতির উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ নয়। এমনকি আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেও এ ধরনের প্রকল্প আছে। সে তুলনায় এসব দেশে কিন্তু বিশ্বমানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। কেননা, একটা অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বা হার্ভার্ড তৈরি করা অনেক কঠিন।
এটা একটা উপমা দিয়ে বললাম। কিন্তু আসল কথা হলো, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা দরকার। এক দিকে ঝুঁকে গেলে ওটা থেকে সুফল পাওয়া যায় না।
আরেকটা কথা হচ্ছে, আমরা অনেক অর্থ ব্যয়ে সফলভাবে বিশাল নদীর ওপর প্রকল্পটি তৈরি করতে পেরেছি। কিন্তু আমরা তো দেশের শত শত নদী, হাওর-বাঁওড়কে অবৈধ দখলমুক্ত করতে পারিনি। এটা করতে কিন্তু অর্থের প্রয়োজন নেই, শুধু আইনের প্রয়োগ দরকার। আর তা করা গেলে নদীপথের অবকাঠামোর উন্নতি হতো তো বটেই, পরিবেশগত ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে কত বড় উপকার হতো, সেটার লাভ-ক্ষতি তো আমরা খুঁজেই দেখিনি।
তাহলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কী করতে হবে?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: পরিশেষে পুরো পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে বলতে পারি, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো সমস্যা আমাদের না। ঋণের দায় পরিশোধ আমাদের আসল সমস্যা না। কিন্তু অবশ্যই বৈদেশিক লেনদেনের প্রবণতাগুলোকে আরও ইতিবাচক দিকে নিতে হবে। আশা করি, সঠিক নীতি নিয়ে সেটা সম্ভব হবে। যদি কোনো বড় ভুল না করি, তাহলে আমরা শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় পড়ব না। কিন্তু আগামী দু-এক বছর যথেষ্ট দুর্ভোগ সইতে হবে। কেননা আমাদের সাধারণ মানুষেরা এখন মূল্যস্ফীতির যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, এটা উপশম করার মতো কোনো নীতি আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। এটা খুবই বেদনাদায়ক একটা বিষয়। কারণ, শুধু নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্তদের জীবনেও টানাপোড়েন চলছে।
এই অবস্থা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত নীতিগুলোর মধ্যে পরিস্থিতির পুরো বিশ্লেষণ থাকা দরকার। কারণ, সমস্যাগুলো একের সঙ্গে অপরটি সম্পর্কযুক্ত এবং গৃহীত নীতিমালার মধ্যে সমন্বয় ও স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। তাহলে দুর্ভোগ হলেও ততটা আতঙ্কময় পরিস্থিতি তৈরি হবে না, অনিশ্চয়তাও কম হবে।
এই পরিস্থিতি থেকে একসময় আমরা উত্তরণ করতে পারব, কিন্তু আমরা অতীতে যে ভুলগুলো করেছি, সেটা থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের রাজস্ব সংগ্রহের যে দুর্বলতা, তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই হবে। মানবসম্পদ তৈরিতে আমাদের আরও বেশি জোর দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় যে অরাজকতা, নীতিহীনতা, মেধার অবমূল্যায়ন—সেগুলোর প্রতিকার করতে হবে।
আমাদের সামনে আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে রপ্তানিকে বহুমুখী করতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত ও মানবসম্পদ উন্নয়নের দরকার হবে। পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে নতুন করে আলাপ-আলোচনা কীভাবে করব, তা–ও ঠিক করতে হবে। যেমন ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে ফেলেছে, চীনভিত্তিক আরেকটা অর্থনৈতিক জোট হয়ে গেছে, সার্ক তো কাজে দিচ্ছে না, কিন্তু প্রতিবেশী ভারত বেশ কয়েক বছর আগেই আসিয়ানের সঙ্গে গিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। এই চুক্তিগুলো করতে কিন্তু যথেষ্ট অর্থনৈতিক কূটনীতির দক্ষতার প্রয়োজন। সুতরাং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার পুরো দুর্বলতার দিকেই আমাদের তাকাতে হবে। এখনকার যে সংকট, এর একটিমাত্র ভালো দিক হতে পারে যদি দুর্বলতাগুলো থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে ঠিক করতে পারি ভবিষ্যতে আমরা কী করব। তাহলেই উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াও আমাদের জন্য সহজ হবে।
নানাভাবে প্রভাবশালীদের সুবিধা দেওয়ার কারণেই কি বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে পারছি না? আসলে সংকটের রাজনৈতিক অর্থনীতিটা কী?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: আমাদের সমস্যা হলো, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে যতটা ব্যবসাবান্ধব করেছি, তার চেয়ে বেশি করেছি ব্যবসায়ীবান্ধব। প্রভাবশালী বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে অনেক বেশি সুবিধা দিতে গিয়ে সম্ভাবনাময় অনেক উদ্যোক্তাকে সমান সুযোগ দেওয়া যায়নি। ফলে সবার জন্য সমতলভূমিও তৈরি করা যায়নি। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল হলো পুঁজি পাচার, ঋণখেলাপি এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতির সীমিত সম্পদের অপচয়।
ব্যাংক ব্যবসার দুর্বলতাগুলো প্রত্যক্ষভাবে চোখে পড়ে না। কিন্তু তা আর্থিক খাতের ভিতকে ক্রমে দুর্বল করে দেয়। এই ক্ষতির বোঝা পুরো দেশের জনগণকে কোনো না কোনোভাবে বহন করতে হয়। ১৯৮০–এর দশকে নিয়ন্ত্রণকাঠামো তৈরি করার আগেই বেসরকারি খাতে ব্যাংক খোলার অনুমোদন দিয়ে বড় ভুল করেছিলাম। তার ফলেই প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা সাধারণ মানুষের রাখা আমানতের একটি বড় অংশ ঋণ হিসেবে বের করে নিতে পেরেছিলেন, যার অধিকাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এরপর অনেক বিধিবিধান করে এবং উচ্চ আদালতের সক্রিয়তার ফলে ৭০ জনের মতো উদ্যোক্তা পরিচালককে পরিচালনা পর্ষদ থেকে অপসারণ ও ঋণ ফেরত দিতে বাধ্য করেছিল।
কিন্তু ইদানীং ব্যাংক খাতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ক্রমে শিথিল করায় আগের সমস্যা তো আছেই, নতুন করেও সমস্যা যোগ হয়েছে। আমরা বাজার অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের শেয়ার কিনে ও অধিগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের ব্যবস্থা রেখেছি। অথচ আর্থিক খাতের মতো একটি সংবেদনশীল খাতে একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা তৈরি করিনি। ফলে আবার নতুন আরেকটা ভুল করেছি। দক্ষিণ কোরিয়ায়ও কিন্তু শুরুতে বড় বড় শিল্পপতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল, তবে তা ছিল শর্ত সাপেক্ষে ও সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য।
তাই পৃষ্ঠপোষকতার অর্থনীতি বা ক্রনি ক্যাপিটালিজম তৈরি হওয়ার আগেই সেখানে ব্যবসার পরিবেশ প্রতিযোগিতামুখী করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে আমরাও বড় ব্যবসায়ী তৈরি করেছি, কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় পরিবেশ তৈরি করতে পারাটাই এখন রাজনৈতিক অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, ক্ষমতা হাতে বেশি এসে গেলে প্রভাবশালীরা পরিবর্তন করতে দেবেন না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যদি বেশি সুযোগ-সুবিধা নেওয়া যায়, তাহলে সেই ব্যবস্থা পরিবর্তনের উৎসাহ থাকার কথা নয়। সুতরাং পরিবর্তনের জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে চীনের প্রবাদের মতোই, আমরা যেদিকে যাচ্ছি, সেদিকেই কেবল যেতে থাকব। কিন্তু তাতে এত দিন যেভাবে অর্জন করেছি, বাকি অর্জন সে পথে আর হবে না।