ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আরেক দফা কমছে। নতুন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিনের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে আজ বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, পরিশোধিত পাম তেল ও সয়াবিন বীজ—এই তিন ধরনের ভোজ্যতেল আমদানি হয় দেশে। এগুলো আমদানিতে ভ্যাট ছিল ১৫ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৭ অক্টোবর ভ্যাটের এ হার কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে। এক দফা ভ্যাট কমানোর এক মাস পার না হতেই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে পরিশোধন কারখানার মালিকেরা ভ্যাটের হার আরও কমাতে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিলেন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে শেখ বশিরউদ্দিনের আজ ছিল তৃতীয় দিন। এরই মধ্যে তিনি ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কারখানার মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বসেন। বৈঠকে সরকারপক্ষে ছিলেন বাণিজ্যসচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান মইনুল খান প্রমুখ।
এ ছাড়া ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এবং সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধিরা।
সভায় পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের সার্বিক দিক তুলে ধরে বিটিটিসি। এরপর ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে মূলবৃদ্ধির কথা বলে দেশীয় বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর দাবি জানান। ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়াবেন না—এমন শর্তে বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে উপস্থিত ব্যবসায়ীরা এই শর্ত মেনে নেন।
বাণিজ্যসচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈঠকে ভোজ্যতেলের ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা হয়তো আগামী রোববার এনবিআরকে চিঠি পাঠাব।’
আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সম্প্রতি এক চিঠিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা সমিতি। সমিতিটি চায় দেশের বাজারেও দাম সমন্বয় করা হোক। এর আগে সর্বশেষ দাম সমন্বয় করা হয়েছিল গত ১৮ এপ্রিল।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে আজ প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭১ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ থেকে ১৭০ টাকা এবং প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১৬২ থেকে ১৬৩ টাকা ও সুপার পাম তেল ১৬৪ থেকে ১৬৫ টাকা দরে বেচাকেনা হয়েছে।
বিটিটিসি নিজেও বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনার মাধ্যমে বিটিটিসি বাণিজ্য উপদেষ্টাকে দেখিয়েছে, এক মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং পরিশোধিত পাম তেলের দাম ১৫ দশমিক ৯১ শতাংশ বেড়েছে। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের উৎস দেশ আর্জেন্টিনা এবং পরিশোধিত পাম তেলের উৎস দেশ মালয়েশিয়া।
এর আগে গত ১৭ অক্টোবর একই বিষয়ে সচিবালয়ে ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা সমিতির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওই বৈঠকে তেলের আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান আজ সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব আসার পর ভ্যাট কমানোর বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রজ্ঞাপন জারির উদ্যোগ নেব।’
ভোজ্যতেলের চাহিদা ও আমদানি পরিস্থিতি
ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রকৃত তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে তিন লাখ টন স্থানীয়ভাবে সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী ইত্যাদি ফসলের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়। বাকি ২১ লাখ টনের চাহিদা পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে।
বিটিটিসির তথ্য অনুযায়ী, ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। আর স্থানীয় উৎপাদন আড়াই লাখ টন। ভোজ্যতেলের মাসিক চাহিদা এক লাখ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টন। তবে রমজানে চাহিদা বেড়ে তিন লাখ টন হয়।
২০২৩ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরে যে পরিমাণ অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল, চলতি বছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। একই সময়ে পাম তেলের এলসিও ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ কমেছে। তবে সয়াবিন বীজের আমদানির এলসি ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।
গত চার মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ২৭ দশমিক ৫৭, পাম তেল ১৮ দশমিক শূন্য ৫ এবং সয়াবিন বীজ আমদানি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ কমেছে।
বিটিটিসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, ১২ নভেম্বর বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিনের দাম ছিল ১ হাজার ১৫১ মার্কিন ডলার আর পাম তেলের দাম ছিল ১ হাজার ২২০ ডলার। এক বছর আগের তুলনায় সয়াবিনের দাম ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কারখানা টিকে গ্রুপের। দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ৭ হাজার ৫০০ টন। এ ছাড়া রয়েছে সিটি, মেঘনা, নুরজাহান, ইলিয়াস ব্রাদার্স, বিইও, স্মাইল ফুড, গ্লোব এডিবল, বসুন্ধরা, এস আলম, মোস্তফা ভেজিটেবল ও সেনা এডিবল ওয়েল। এসব প্রতিষ্ঠানের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ২৫ হাজার ৫০০ টন।