মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ফলে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষেরা। জিনিসপত্রের বাড়ন্ত দাম খেয়ে ফেলছে বাড়তি আয়ের টাকা। দেশে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি বাড়ছে তার তুলনায় কম হারে। এভাবেই মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ আপনার খরচ করার সামর্থ্য কমাচ্ছে।
এর সহজ ব্যাখ্যাটি এমন—গত মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর মানে হলো, ২০২২ সালের মার্চে চাল, ডাল, তেল, নুন, পোশাক-আশাক, বাসাভাড়া, যাতায়াতসহ আপনার জীবনযাপনের খরচ চালাতে যদি ১০০ টাকা খরচ হতো, তাহলে এ বছরের মার্চে একইভাবে জীবন যাপন করতে আপনার খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৩৩ পয়সা। খরচ বৃদ্ধির হার ৯ দশমিক ৩৩। এ হিসাব সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)।
দেখা যাক এ বাড়তি খরচের ভার সামাল দিতে আপনার আয় কতটা বাড়ল। বিবিএস বলছে, জাতীয় মজুরি বেড়েছে এবং বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ১৮। এর মানে দাঁড়ায়, ২০২২ সালের মার্চে যদি আপনার আয় ১০০ টাকা হয়, তাহলে এ বছরের মার্চে আপনার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৭ টাকা ১৮ পয়সা।
সুতরাং আয় খানিকটা বাড়লেও আপনাকে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় একই পণ্য ও সেবার জন্য বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ফলে খরচের ফর্দ কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
আপনার আয় বাড়লেও খরচ যখন তার তুলনায় বেশি বাড়ে, তখন আসলে আপনার প্রকৃত আয় কমে যায়। বাংলাদেশে এখন ঠিক তা-ই ঘটছে। দেশের ৮০ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। এগুলোর প্রায় শতভাগই মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান।
তবে শুধু গত মার্চে নয়, এক বছর ধরেই এ অবস্থা চলছে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। গত এক দশকে দীর্ঘ সময় ধরে এমন চিত্র দেখা যায়নি। এর আগে দেখা গেছে, এক-দুই মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরির হার বৃদ্ধি কম থাকলেও পরে আবার মজুরির হার বেড়ে যায়।
‘বাজারের খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। গরিব মানুষেরা এক বছর আগে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কিনতে পারতেন, এখন তার ৬০ শতাংশ পণ্যও কিনতে পারেন না। মানুষের প্রকৃত আয় ভয়ানকভাবে কমে যাচ্ছে। খরচ করার সামর্থ্য কমছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। অনেকের তো সঞ্চয়ও নেই।’সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারের খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। গরিব মানুষ এক বছর আগে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কিনতে পারত, এখন তার ৬০ শতাংশ পণ্যও কিনতে পারে না। মানুষের প্রকৃত আয় ভয়ানকভাবে কমে যাচ্ছে। খরচ করার সামর্থ্য কমছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। অনেকের তো সঞ্চয়ও নেই।’
সেলিম রায়হানের মতে, বিবিএস একটি গড় জাতীয় মূল্যস্ফীতির হিসাব দেয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেশি।
সাধারণত প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়, এর বেশি হারে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধি হয়। কিন্তু এক বছর ধরে এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত বছরের মার্চ থেকে মজুরি বৃদ্ধির হারকে টপকে যায় মূল্যস্ফীতি। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার হয় ৬ দশমিক ১৫।
এরপর আর কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতিকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি মজুরি। তবে এ সময়ে মজুরি ও মূল্যস্ফীতি দুটিই বেড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির গতি বেশি। রূপক অর্থে বলা যায়, মজুরি হার বেড়েছে টেস্ট ব্যাটসম্যানের মতো। এ ক্ষেত্রে রান, অর্থাৎ আয় বেড়েছে ধীরে ধীরে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির গতি ছিল টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যানের মতো। দ্রুতগতিতে চার-ছক্কা উঠেছে।
প্রায় গত ডিসেম্বরে মজুরি বৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর ছোঁয়। অন্যদিকে মার্চের পর থেকে ওই ৯ মাসে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশের ঘর পেরিয়ে সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে উঠে যায়। গতকাল মঙ্গলবার বিবিএসের প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির হার এখন ৯ দশমিক ৩৩।
সাড়ে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই শুরু হয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় এর কয়েক মাস আগে থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। কিন্তু আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানোর পর মূল্যস্ফীতি একলাফে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়, যা ছিল ২০১১ সালের এপ্রিলের পর সর্বোচ্চ।
এরপর টানা পাঁচ মাস সময় ধরে মূল্যস্ফীতি কমছিল। কিন্তু এ হার সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি।
এত দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম থাকা বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, আয় কমে যাওয়ায় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষেরা খাবার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ কাটছাঁট করছেন। ফলে তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষার্থীদের পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তারা শিক্ষায় পিছিয়ে যেতে পারে। এতে সার্বিক অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা কমার শঙ্কা আছে।