দেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় হচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। সবাই কি একই বিচার পাচ্ছে? থানায় যখন কেউ যান অভিযোগ নিয়ে, পুলিশ কি সবাইকে সমানভাবে সেবা দিচ্ছে? সবাই কি ব্যাংকঋণ পাচ্ছে? এসব প্রশ্ন তুলে রেহমান সোবহান বলেন, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে কাজ করছে না। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ধানমন্ডি কার্যালয়ে আজ বৃহস্পতিবার দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ: ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান এ সব কথা বলেন। গত নভেম্বরে লন্ডন থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এ বইয়ের সম্পাদক সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান।
যাঁদের লেখা বইয়ে ছাপা হয়েছে, তাঁরা হলেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক এম এম আকাশ ও সেলিম জাহান, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান খাতের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক প্রধান বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আখতার মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের আরেক শিক্ষক সেলিম রায়হান, ইউনিভার্সিটি ব্রুনেই দারুসসালামের শিক্ষক ইফতেখার ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, স্থপতি কাজী খালেদ আশরাফ, সাপ্লিমেন্টারি অধ্যাপক ফকরুল আলম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ, ইউনিভার্সিটি অব অসলোর অধ্যাপক আরিল্ড এঙ্গেলসন রুদ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো সোহেলা নাজনীন প্রমুখ।
বইয়ের পর্যালোচক ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের চেয়ারপারসন ফেরদৌস আজিম এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
দেশের ২৫ বছর বয়সে ১৯৯৬ সালে আরেকটি বই প্রকাশ করা হয়েছিল জানিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, অর্থনীতি নিয়ে তখন অতটা উচ্চাশা করা হয়নি। পোশাক খাত তখন ছিল বাইরে থেকে কাপড় এনে সেলাই করে দেওয়ার শিল্প। কতটা মূল্য সংযোজন হতে পারে, তা ওইভাবে ভাবা হয়নি। এমনকি প্রবাসী আয় নিয়েও অতটা চিন্তা করা হয়নি। পরের ২৫ বছরে অনেক পার্থক্যই খুঁজে বের করা হয়েছে। পোশাক খাতে এখন সংযোগ শিল্প অনেক বড়। এখন বছরে প্রবাসী আয় আসে দুই হাজার কোটি ডলারের মতো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েক বছর আগেও ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব উন্নয়নের দিক থেকেও বাংলাদেশের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে।
বইয়ে প্রকাশিত লেখকদের লেখার সূত্র ধরে রেহমান সোবহান বলেন, ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের পুনর্জন্ম হয়েছে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভালো একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনও হয়েছে। দুই দলের রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা হয়েছিল তখন। নির্বাচনের এ পদ্ধতি পাকিস্তান ও নেপাল গ্রহণ করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এখন আমরা কী দেখছি? এখন দেখছি গণতন্ত্রের অবক্ষয়।
নতুন একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাজনীতিতে এসেছে—এ কথা উল্লেখ করে বইয়ের লেখকদের লেখার সূত্রে রেহমান সোবহান প্রশ্ন তোলেন, ব্যাংক খাতে সবাই কি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পান? তিনি বলেন, স্বল্প মেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ তুলে দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের সমস্যা প্রকট। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যাংক ও পোশাক খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। একদিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অন্যদিকে শাসনব্যবস্থায় নীতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে।
শাপলা চত্বর ও শাহবাগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এখনো চলমান বলেও মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান।
বইয়ের লেখক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে, তা চোখের সামনেই রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আর জাতিসংঘের হিসাবে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে হতে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ। তবে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমরা সামনে টেকসই হব কি না, মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ব কি না, তা এখন বড় চিন্তার বিষয়। কারণ, ব্রাজিল ৩৫ বছর এবং ফিলিপাইন ৩৩ বছর ধরে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে আটকে আছে।’
বইয়ের একটি অংশের লেখক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতি এখন ধনীদের মূল লক্ষ্য। আগে তাঁরা দুর্নীতি করতেন ধনী হতে। আর এখন দুর্নীতি করছেন নিজেদের নিরাপত্তার জন্য।’ সস্তা শ্রমে আটকে গেছি—এমন মন্তব্য করে হোসেন জিল্লুর বলেন, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক লক্ষ্য হতে হবে রাজনৈতিক।
আরেক লেখক সেলিম রায়হান বলেন, ‘দেশে উন্নয়ন ও স্থায়ী দুর্নীতি একই সঙ্গে এগিয়েছে। দুর্নীতিবাজরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের ভাঙার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। ৫০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য আছে। আবার আছে প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাও। আর এই সময়ে আমরা কি বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে এগোব না বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে, তা–ও ভাবার বিষয়।’
ব্যাংক খাত ও বিচারব্যবস্থায় উন্নতির বদলে নিম্নগামিতা দেখা যাচ্ছে বলেও মনে করেন সেলিম রায়হান।
আরেক অংশের লেখক এম এম আকাশ বলেন, দারিদ্র্যের হার কমেছে। কিন্তু বেড়েছে বৈষম্য। গরিবের উন্নতি শামুকের গতিতে হয়েছে আর ধনীদের হয়েছে রকেট গতিতে। অন্যদিকে শ্রমিকের গড় উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে মজুরি বাড়েনি।
লেখকদের লেখার সূত্র ধরে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন হয়েছে ভবিষ্যৎকে বন্ধক রেখে। প্রতিবেশগত দিক থেকে বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে যত অবিচার হয়েছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আমলেও ততটা হয়নি।’
উন্নয়নের এ পর্যায়ে এসে আবার না পিছলে পড়ে যেতে হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন জাহিদ হোসেন।