আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)

ডিএমডির সফর

আইএমএফের ঋণ পেতে সংস্কারের প্রস্তুতি

কিছু শর্ত ইতিমধ্যেই পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ঋণ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে ১৪ জানুয়ারি আসছেন আইএমএফের ডিএমডি।

এখন সময় একটু খারাপ—এ কথা বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চায় বাংলাদেশ। আইএমএফ এ ডলার দিতেও রাজি। তবে সংস্থাটি এ জন্য অর্থনীতির সংস্কার করতে বলেছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

ঋণ পাওয়া যাবে বলে প্রাথমিকভাবে ফায়সালা হয়ে আছে গত অক্টোবর-নভেম্বরে আইএমএফের মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দের সফরকালেই। তারপরও ঋণ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে এবার আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ আসছেন ঢাকায়। ১৪ জানুয়ারি শনিবার ঢাকায় পৌঁছাবেন তিনি। ফিরে যাবেন ১৮ জানুয়ারি।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, আইএমএফের ডিএমডির বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে ফিরে গিয়ে তিনিই বাংলাদেশের বর্তমান আর্থিক অবস্থা এবং ঋণ দেওয়ার যৌক্তিকতা সংস্থাটির অন্য সদস্যদের কাছে তুলে ধরবেন।

শর্ত পূরণ না করার জন্য ফাঁকি দিতে চাইলে কায়দা-কানুন করে ফাঁকি দিতেই পারবে সরকার। তাতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খারাপ হবে।
আহসান এইচ মনসুর, অর্থনীতিবিদ

গত জুলাইয়ে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। এরপর গত ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে দুই সপ্তাহের বৈঠক করে গেছে আইএমএফের দল। দলটি চলে যাওয়ার দিন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে গেছে, বাংলাদেশ ঋণ পেতে পারে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও ওই দিন ঋণ পাওয়ার ব্যাপারেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

আইএমএফের দলের সঙ্গে অক্টোবর-নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বৈঠকে প্রধানত আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়গুলো ওঠে এসেছে। মিশন চলে যাওয়ার পর পার হয়েছে দুই মাস। এরই মধ্যে সম্ভাব্য শর্তগুলোর একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের মতে, মোটাদাগে শর্ত তিনটি। আর তিন শর্তের আওতায় রয়েছে আরও ২৪টি উপশর্ত।

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, ২৯ জানুয়ারি বসবে আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক এবং আইএমএফের ডিএমডি অ্যান্তইনেত সায়েহ বাংলাদেশ সফর করে চলে যাওয়ার পরই ঋণ প্রস্তাব উঠবে পর্ষদে। পর্ষদে প্রস্তাবটি তাঁরই উত্থাপন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

পর্ষদে ঋণ প্রস্তাব তোলার আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের যৌথ স্বাক্ষরে চুক্তির একটি খসড়া যাবে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে। পর্ষদ অনুমোদন দেওয়ার পরই ঋণের শর্তগুলো প্রকাশ করবে আইএমএফ। চূড়ান্ত চুক্তি হবে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার আগে আগে।

পর্ষদের অনুমোদনের বড়জোর ১০ দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এটা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সাত কিস্তির এ ঋণের সর্বশেষ কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। ঋণের গড় সুদহার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।

ডিএমডির সফরে কী কী থাকছে

আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যাবেন অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ আয়োজিত মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে অনুষ্ঠেয় এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকেরাই অংশ নিতে পারবেন। আইএমএফের ডিএমডি ১৮ জানুয়ারি যাবেন পদ্মা সেতু দেখতে এবং ওই দিনই তিনি ঢাকা ছাড়বেন।

সম্ভাব্য শর্তগুলো

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আইএমএফের প্রধান তিনটি শর্ত হচ্ছে গুণগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত (কিউপিসি), অবকাঠামোগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত (এসপিসি) ও সাধারণ প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যে কিউপিসি হচ্ছে বাধ্যতামূলক শর্ত। এ শর্ত মানতেই হয়।

বহু বছর থেকেই বলে আইএমএফ বলে আসছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক নেই। এবার এটি সংশোধনের কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে তা ঠিক করার কাজে হাত দিয়েছে।

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের হার এখনো ১০ শতাংশের নিচে। আইএমএফ এ ব্যাপারে মানসম্মত একটি হার চাইবে। আর সরকারের বাজেটঘাটতি একটি নির্দিষ্ট হারের বেশি যেতে পারবে না—এমন শর্তও থাকবে। যখনই কিস্তি দেওয়ার সময় হবে, আইএমএফ এগুলো মিলিয়ে দেখবে।

এসপিসির মধ্যে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতি কার্যকর করা, আয়কর আইন সংসদে পাস করা, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা, আদায়ের অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, করছাড়ের ওপর বিশদ নিরীক্ষা করা, বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য রাখা।

এ ছাড়া রয়েছে ভর্তুকি কমানো, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, ব্যাংকঋণের বর্তমান সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দেওয়া, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম একইভাবে সমন্বয় করা হবে। অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই তিনি এ কথা বলেছেন। ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের আইনগুলোও করা হচ্ছে।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, যতটুকু দেখছি বাংলাদেশকে ঋণ দিতে আইএমএফ বেশ নমনীয় মনোভাবেই আছে। বাংলাদেশেরও উচিত হবে এ নমনীয়তাকে সম্মান জানানো। অর্থাৎ আইএমএফ যে যে শর্ত দেবে, তা পূরণ করলে চূড়ান্ত অর্থে বাংলাদেশেরই লাভ হবে। তবে পর্ষদ বৈঠক হওয়ার পরই বোঝা যাবে কঠিন শর্ত কিছু থাকছে কি না।

আহসান মনসুর আরও বলেন, শর্ত পূরণ না করার জন্য ফাঁকি দিতে চাইলে কায়দা-কানুন করে ফাঁকি দিতেই পারবে সরকার। তাতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খারাপ হবে। তবে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে প্রতি কিস্তির আগেই আলাদা করে পর্যালোচনা করবে আইএমএফ। সেখানে শর্ত পূরণ না হলে কিস্তি আটকে যাওয়ার উদাহরণও আছে। এতে দেশীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে।