মূল্যস্ফীতি
মূল্যস্ফীতি

জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশের ওপরে, ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ

দেশে গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে জুলাই মাসে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাসটিতে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যায়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মূল্যস্ফীতিও যেন লাফ দিয়ে বেড়ে গেছে। এত দিন ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছিলেন অর্থনীতিবিদেরা।

বিবিএসের হিসাবে, গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাই মাসে বেড়ে ১৪ শতাংশ ছাড়াল। যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

গতকাল সোমবার বিবিএস জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। বিবিএসের হিসাবে, এর আগে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এরপর গত জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ।

কয়েক বছর ধরে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, বাস্তবে সেটি আরও বেশি। সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের এ অবিশ্বাসের মধ্যেও এক বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন শঙ্কা ছিল মূল্যস্ফীতির তথ্য কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য হয়তো এটা করা হয়েছিল। কারণ বাজারের জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির তথ্য মিলছিল না। এখন রাজনৈতিক সরকার নেই। তাই মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। জুলাই মাসে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এর প্রতিফলনও দেখা গেছে মূল্যস্ফীতির হিসাবে।

মূল্যস্ফীতি হলো একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষ সবার ওপর চাপ বাড়ায়। গত জুলাই মাসে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হওয়ার মানে হলো, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনেছেন, চলতি বছরের জুলাই মাসে একই পণ্য ও সেবা কিনতে তাঁর খরচ হয়েছে ১১১ টাকা ৬৬ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১১ টাকা ৬৬ পয়সা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিবিএসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের ১৫৪টি বাজার থেকে তথ্য–উপাত্ত অনলাইনে সংগ্রহ করে জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়েছে। গত মাসে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় হঠাৎ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে থাকতে পারে।

১৩ বছরে সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে। জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে। জুলাইয়ে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে, তা গত ১৩ বছর ৪ মাস বা ১৬০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের এপ্রিলে, ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এরপর আর কখনো খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশে ওঠেনি।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, এত খাদ্য মূল্যস্ফীতি অসম্ভব উদ্বেগের বিষয়। এ অবস্থায় গরিব মানুষকে সুরক্ষা দিতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতায় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের কর্মসংস্থান আরও সংকুচিত হয়েছে। তাঁদের আয় কমেছে। তাতে আরও বেশি চাপে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষেরা।

বিবিএসের হিসাবে, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। গত জুলাইয়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশে। জুনে এই হার ছিল ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই এখন অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়ে গেলে গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বাড়ে। এমনিতে বাজারের জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্যবহির্ভূত খাতেও খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ।