চাঁদপুরের পাউবো কার্যালয় থেকে শহর রক্ষা বাঁধের দূরত্ব চার কিলোমিটার। তাতেও প্রকল্প পরিচালকের জন্য কোটি টাকার গাড়ি কেনা হবে।
চাঁদপুর জেলা শহরের ষোলঘর এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আঞ্চলিক কার্যালয় অবস্থিত। সেখান থেকে মাত্র চার কিলোমিটারের মধ্যেই মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনা।
দুই নদীর মোহনার মুখে থাকায় চাঁদপুর শহরটি ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকে। এ জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করে নদীর তীর সংরক্ষণ করা হয়। এখন নতুনভাবে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় করে এই বাঁধ মেরামতের মাধ্যমে নদীতীর সংরক্ষণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় থেকে চার কিলোমিটার দূরের প্রকল্প এলাকায় প্রকল্প পরিচালকের আসা–যাওয়ার জন্য একটি জিপ গাড়ি কেনা হচ্ছে। পাঁচ দরজাবিশিষ্ট এই গাড়ি কেনা হবে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রি থেকে। এ জন্য প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক কোটি টাকা। প্রকল্প দলিলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
অর্থনীতির এই সময়ে প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় গাড়ি কেনা টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকল্পের গাড়ি কেনা, বিদেশ ভ্রমণ—এসব যেন ব্যাধি হয়ে গেছে। এই অপচয় বন্ধ করা উচিত।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই।
গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চার বছর মেয়াদের ‘চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন’ নামের এই প্রকল্প পাস হয়েছে। এতে খরচ হবে ৮২৭ কোটি টাকা। ২০২৭ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
পাউবোর চাঁদপুর কার্যালয়ে এখন যে গাড়ি নেই, তা নয়। জানা গেছে, কার্যালয়ে তিনটি জিপ ও তিনটি মোটরসাইকেল রয়েছে। সেগুলো মেরামতের জন্য এই প্রকল্পে আট লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া চারটি নতুন মোটরসাইকেলও কেনা হবে ১০ লাখ টাকায়।
দেশের অর্থনীতি বর্তমানে একধরনের সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। সে জন্য সরকার খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রকল্পে গাড়ি কেনা বন্ধ রাখা। এ অবস্থায় মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে যাতায়াতের জন্য যখন কোটি টাকার নতুন গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন সংগত কারণেই তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, নতুন গাড়ি ছাড়া কি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় না?
প্রকল্প এলাকাটি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নির্বাচনী এলাকায় পড়েছে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের জনতুষ্টির প্রকল্প ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর জন্য ভালো হলেও সরকারি অর্থের তো অপচয় ঘটে। এর আগেও চাঁদপুরের কয়েকটি প্রকল্পের খরচ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সাধারণত কোনো প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর সেটির খরচের নানা দিক পর্যালোচনা করে তবেই অনুমোদন করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে এই প্রকল্প প্রস্তাবে দুটি জিপ গাড়ির কেনার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শর্তসাপেক্ষে একটি গাড়ি অনুমোদন করা হয়। শর্তটি হলো গাড়ির কেনার আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এ কে এম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই প্রকল্প প্রস্তাবে প্রথমে একাধিক গাড়ি কেনার প্রস্তাব আসে। আমরা অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে একটি গাড়ি অনুমোদন করেছি। বর্তমান ওই কার্যালয়ে যেসব গাড়ি আছে, সেগুলো ১৫-১৬ বছরের পুরোনো। তাই নতুন গাড়িটি কেনা হলে তা অন্য কাজেও ব্যবহার করতে পারবে।’
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গাড়িটি কেনার বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চার বছর এই প্রকল্পে তিন-চার কিলোমিটার যাতায়াতের জন্য গাড়ি ভাড়া করলেই হতো। অর্থনীতির এই সময়ে প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় গাড়ি কেনা টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকল্পের জন্য গাড়ি কেনা ও বিদেশ ভ্রমণ—এসব যেন ব্যাধি হয়ে গেছে। এই অপচয় বন্ধ করা উচিত।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এখনো প্রকল্পটিতে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় শিগগিরই নিয়োগ দেবে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বা তদূর্ধ্ব পদের কোনো কর্মকর্তা এই প্রকল্পের পরিচালক পদ পাবেন। এ রকম পদের কেউ চাঁদপুর কার্যালয়ে নেই।
পাউবো চাঁদপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, ‘তাঁদের কাছে বর্তমানে তিনটি জিপ গাড়ি আছে। এই গাড়িগুলো বেশ পুরোনো, যখন-তখন রাস্তায় বিকল হয়ে যায়। নতুন গাড়ি কেনা হলে তা শুধু এই প্রকল্পের এলাকায় নয়, অন্য প্রকল্পেও ব্যবহার করা হবে।’
চাঁদপুর শহরকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় ১৯৭৩ সাল থেকে পাঁচ দফায় নদীতীর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১০ সালে শেষ দফা কাজ করা হয়। এখন আবার বাঁধ সংরক্ষণ ও মেরামতের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।